Sunday, August 7, 2011

কালের আচার - কালচার -- ধানসিঁড়ি

ছবির উৎস: লিঙ্ক
"সংস্কৃতি" এ এক বড্ড খটমটে শব্দ। চারশো বছরের বেশি সময় ধরে যে শব্দটিকে
নিয়ে নাড়া-ঘাঁটা করেছেন পণ্ডিতেরা সেই শব্দটিকে এক-দু কথায় ব্যাখ্যা করতে চাওয়ার বাসনা পাতি কথায় বাড়াবাড়ি। তবু "কথা তো বলার জন্যেই"...
সংস্কৃতি নিয়ে আজকাল "ইন্টালেকচুয়াল"-দের (intellect যাঁদের চোয়ালে আটকে আছে) মধ্যে বড়ো গোল দেখা যায়। প্রতিপক্ষ (এ রাজ্যের মানুষেরা পড়ুন 'আমরা ওরা') ছাড়া যেমন কোনো তর্ক জমে না, তেমনি সংস্কৃতি বিষয়ে কথা বলার সময়ও যেন অপসংস্কৃতি নামক একটা অন্যপক্ষ দাঁড় না করালে এ আলোচনাটা ঠিক ধোপেই টেকে না। আরে বাপু! কাকে বলে অপসংস্কৃতি? এই সংস্কৃতির আগে একটা "অপ" উপসর্গ জুড়ে অপবাদ দেওয়ার আমি আপনি কে? যাক, এ প্রসঙ্গ এখানে থাক।
কোনো তত্ত্বের কচকচিতে না গিয়ে যদি সংস্কৃতি কী বা কাকে বলে গোছের একটা মানে করতে চাই তাহলে বলব আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি, শুনি, বোধ করি তা সবই আমার সংস্কৃতির অঙ্গ। অর্থাৎ একটা বিশেষ গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অভ্যেসে (শব্দটিকে মাথায় রাখবেন) তৈরি হওয়া এক সামগ্রিক অভিজ্ঞতা বা বলা যেতে পারে বোধ। চৌহদ্দি আরো বাড়ালে এতে আচার ব্যবহার এসবও ঢুকে পড়ে অনায়াসে।
শব্দটির বিকাশের ইতিহাস এত দীর্ঘ যে নানা সময় এর অর্থ পাল্টে পাল্টে গেছে। তবু এটা আমাদের জানা যে একদম শুরুতে 'culture' শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে কৃষি বা কর্ষণ অর্থে। হয়তো এটাকে মাথায় রেখেই রবীন্দ্রনাথ এর বাংলা করেছিলেন 'কৃষ্টি'। কিন্তু কালচার বোঝাতে 'কৃষ্টি' শব্দটির ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে। 'সংস্কৃতি' ই চলতি । আমিও এক্ষেত্রে চলতি হাওয়ার পন্থী। তবে একটা ছোট্ট কথা। শব্দটির ব্যবহার উঠে গেলেও একথা সকলেই কমবেশি মানতে পারি কালচার আসলে এক অর্থে মনেরই কর্ষণ।

ছবির উৎস: লিঙ্ক

এই 'মন' ব্যাপারটাই যত নষ্টের গোড়া। এখানে মন আর আমার বা আপনার একা কারোর ব্যক্তিমন নয়, একটা সমগ্রের মন। এখানে আমার চেতনার রং টং বলে কিছু নেই, আছে একটা যূথের চেতনা, একটা যৌথজ্ঞান। এই যৌথজ্ঞানই ধীরে ধীরে অভ্যেসের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় যৌথনির্জ্ঞানে (collective unconscious)যা কোনো একটা সংস্কৃতি গড়ে ওঠার অন্যতম শর্ত। সমস্যাটা এখানেই। একে সবার মন তার ওপর আবার অসচেতন মন। যুঝতে হচ্ছে দুটো স্তরে- ব্যক্তি বনাম সমষ্টি আর সচেতন বনাম অসচেতন। এই থিসিস (ব্যক্তি/সচেতন)আর অ্যান্টিথিসিসের (সমষ্টি/অসচেতন) সমন্বয়ের প্রোডাক্ট সংস্কৃতিনামক সিন্থেসিস। এসব থিয়োরি খাতায় কলমে ঝামেলা বাধায় না। বাধায় রোজকার চলাফেরায়,ওঠাবসায়।
বহু চর্চিত আর সেকারণেই আপাত ক্লিশে এই বিষয়টি নিয়ে কতগুলো ভাবনা মাঝে মাঝে ভাবায়। ভাবনাগুলোর সমাধান যেহেতু স্পষ্ট করে এখনো পাইনি তাই আপাতত ভাবনাগুলোকেই এই পরিসরে একটু আওড়ে নিতে চাই সমাধানের কোনো সুপ্ত আশায়।

ভাবনা এক - সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যেস ব্যাপারটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অভ্যেসের একটা  ধর্ম জড়তা, জাড্য (চন্দ্রিলের ভাষায় inertia; বলার লোভ সামলাতে পারলাম না!)। সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে তা কখনো কখনো বেশ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বাধাটা কখনো এতটাই মারাত্মক আকার নেয় যে নির্দিষ্ট ওই মানুষটি অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে শুরু করে। সে ভুল না ঠিক বা ভুল হলে কতটা ভুল বা কেন সে ভুল এসব প্রশ্নে নিজেকে ফালাফালা করতে থাকে। দমবন্ধ অবস্থায় ভয়ংকর বোধে আক্রান্ত হয়ে সে বিড়বিড় করতে থাকে সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?” অভ্যেসের এই সংস্কৃতি কি কাম্য! জাড্য ছাড়াও অভ্যেসের আরেকটা দিক আছে -নমনীয়তা। সেদিকে একটু নজর ফেরাতেই পারি আমরা।

ভাবনা দুই - যেকোনো 'ডেভেলপমেন্ট' (প্রযুক্তি থেকে ঘরের কোণ পর্যন্ত) সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বিষয়টা হল এই উন্নতির হাত ধরে এমন কিছু অনুষঙ্গ অবশ্যম্ভাবী ভাবে এসে পড়ে আমাদের জীবনযাপনের মধ্যে যা অনেকের কাছে প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে একটা আঘাত তৈরি করে। প্রশ্ন হল উন্নতি আর ঐতিহ্যের এই দ্বন্দ্ব কি স্বাস্থ্যকর? এককথায় এর উত্তর না। কিন্তু এই 'না' টা জোর গলায় যদি বলতে চান, বোঝাতে চান তাহলে একদল (তারাই বড় দল) আপনাকে হয় বেড়েপাকা বা উচ্ছন্নে গেছে বলে গাল পাড়বে। বা একটু বাড়িয়ে অপসংস্কৃতিও বলতে পারে।



ছবির উৎস: লিঙ্ক

ভাবনা তিন- অপসংস্কৃতি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘোরতর আপত্তি আছে। আপত্তিটা লেখার শুরুতেই কিছুটা বলে ফেলেছি। শুধু এই শব্দটি নিয়ে আমার ছুঁতমার্গ আছে তা নয়, শব্দটার আড়ালে যে মননটার পরিচয় ধরা আছে আপত্তিটা সেখানে। কোনো জিনিস ভালো কি মন্দ তা বলার অধিকার অবশ্যই ব্যক্তি বিশেষের আছে, কিন্তু যেখানে এই ভালোমন্দ ব্যাপারটা অনেকটাই আপেক্ষিক, অনেকটাই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত সেখানে কোনো কিছু কে ভালো বা মন্দ (এখানে 'অপ') বলে তকমা লাগিয়ে দেওয়াটা সচেতন নাগরিকের অতি-সচেতনতার পরিচয়। যা আখেরে নিজেদের সংস্কৃতির মধ্যেকার বিভাজনকে আরো স্পষ্ট করে। বিভাজনকে চেনানোটা আমাদের লক্ষ্য না তা মুছে ফেলার চেষ্টা করাটা?
এই অভ্যেসের বাধা, ঐতিহ্যের টানাপোড়েন,সংস্কৃতি - অপসংস্কৃতির বিভাজন এসব থাকবেই। বরং না থাকার দাবী করাটা সোনার-পাথর বাটির মতোই অবিশ্বাস্য। তবু যদি এসবের মধ্যেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা একটু flexible হই তাহলে মনে হয় সংস্কৃতির আনাচে কানাচে একটু খোলা মনে ঘুরে বেড়াতে পারব। তখন আর আমার সংস্কৃতি আমার কাছে যক্ষপুরী হয়ে থাকবে না। আমরাও গলা ছেড়ে গাইব "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে...

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই