ছবি: সুনন্দ |
যুগ
বদল, ফোন বদল
১৯৯০ থেকে ২০১১।
চার দিকে কত বদল যে ঘটে
গিয়েছে তা ভাবলে ক্রমেই অবাক হয়ে
যেতে হয়। বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবী বাদ দিলে ২০-২১ বছরে এত বড় বদল ইতিহাসের আর কোনও সন্ধিক্ষণে হয়েছে কি না, বলা শক্ত। উদারনীতিবাদের হাত ধরে কী ভাবে আমার দেশের রূপ বদল হয়েছে, তা নিয়ে তাত্ত্বিকেরা অনেক আলোচনা করছেন। ভেবে দেখছিলাম, এই দশ বছরে আমাদের মতো মানুষের দুনিয়া সত্যিই কতটা বদলেছে? বদলে যেতে যেতে আমরা কোন কোন অভ্যেস প্রায়
যেতে হয়। বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবী বাদ দিলে ২০-২১ বছরে এত বড় বদল ইতিহাসের আর কোনও সন্ধিক্ষণে হয়েছে কি না, বলা শক্ত। উদারনীতিবাদের হাত ধরে কী ভাবে আমার দেশের রূপ বদল হয়েছে, তা নিয়ে তাত্ত্বিকেরা অনেক আলোচনা করছেন। ভেবে দেখছিলাম, এই দশ বছরে আমাদের মতো মানুষের দুনিয়া সত্যিই কতটা বদলেছে? বদলে যেতে যেতে আমরা কোন কোন অভ্যেস প্রায়
ভুলতে বসেছি?
মধ্যবিত্ত মফসসলি পরিবারের
জীবনযাপন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছোটো ছোটো কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে এই লেখা সাজাব। এর মধ্যে
প্রথমেই মনে পড়ছে টেলিফোনের কথা। এখন যে যন্ত্র আমাদের অস্তিত্বের সরিক, তার
পূর্বসূরির কথা দিয়ে মুখ খুলছি। মানে, মুখবন্ধ করছি।
ফোন-বাড়ি
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
’৯০-এর দশকে লোকে ফোন
বলতে কেবল বুঝতো ‘ল্যান্ড ফোন’ বলে
অধুনা একঘরে হয়ে যাওয়া যন্ত্রটিকেই। আর সেই ‘ল্যান্ড ফোন’
ঘিরে কতই না রোম্যান্টিসিজম ছিল। প্রথমত, তখন
কালো ডায়াল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নম্বর দেওয়ার দিন প্রায় ফুরিয়েছে। তবু যদি কারো বাড়িতে
ওই বিরল প্রজাতির ফোন থাকত, তা হলে তা রীতিমতো দর্শনীয় বস্তু
হয়ে উঠত। বেশিরভাগ বাড়িতে তখন ওই ফোনের জায়গায় দখল নিতে চলেছে ‘ইলেক্ট্রনিক’ফোন।
কেন যে কালো কালো বোতাম টেপা বেশিরভাগ সাদা-লালের রিসিভারকে ‘ইলেক্ট্রনিক ফোন’ বলত জানি না। [আগের প্রজন্মের
ফোনগুলো তো আর মেকানিক্যাল বা সিভিল এঞ্জিনিয়রেরা বনাতেন না।] সেই রিসিভার,
তার রং, তার আওয়াজ মিষ্টি কি না, এ নিয়ে মফস্সল শহরে বন্ধু বা বিকেলে মা-দের আড্ডার মধ্যে বেশ জায়গা করে
নিত। কার বাড়িতে সকালে ফোনটা বেজে বেজে থেমে গিয়েছে, কার
বাড়িতে দু’বারের বেশি
ফোন বাজে না, বা কার বাড়িতে সকালে একটা অদ্ভুত ফোন
এসেছিল-এই সব।
জ্যাঠার বাড়িতে গেলে এমনই
অদ্ভুতুড়ে ফোনের কথা প্রায় শোনা যেত। যেমন এক দিন জ্যাঠা বলল, “জানিস,আজ এক জনকে টাইট করে দিয়েছি।” কেন জ্যাঠা কী হয়েছিল? জ্যাঠা বলল, “আজ সক্কাল বেলায় ফোন করে এক জন বলল, ‘হরিপদ
মিস্ত্রিকে ডেকে দিন।’” তুমি কী বললে? জ্যাঠা
বলল, “বললাম, হরিপদ এখন প্রকৃতির ডাকে
সাড়া দিতে [পড়ুন একদম কথ্য শব্দবন্ধটি...] গিয়েছে। এলে ডেকে দেব। কে ফোন করেছে বলব?”
উত্তর এল, বলবেন, ‘ক্যালাচাঁদ
পাল’। ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে জ্যাঠা নাকি স্বগতোক্তির মতো
বলেছিল, [যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোনের ও-পার থেকে অস্ফুট
শোনা যেত], ‘যেমন নাম, তেমন কাজ। ফালতু
লোক কোথাকার’।
যে হেতু তখন সকলের বাড়িতে ফোন
থাকত না, তাই দু’এক জন পড়শির ফোনও আসত ‘ফোন বাড়িতে’। ঠিক যে ভাবে আমরা পেয়েছিলাম, মাধ্যমিকে কালনা সাবডিভিশনে দিদির প্রথম হওয়ার খবর। বা, বিশ্বভারতীতে পড়ার সময় কেমিস্ট্রি ল্যাব-এ কাজ করতে করতে দিদির চোখে হঠাৎ
কস্টিক সোডা [অ্যালকালাইন সাবস্ট্যান্স] পড়ে যাওয়ার সংবাদ। কী চিন্তা হয়েছিল,
চোখ ফিরে পাবে তো দিদি? ফিরে পেলেও, দৃষ্টিশক্তি ঠিক থাকবে তো? আনন্দ-উদ্বেগ বয়ে আনত যে যন্ত্র, মধ্যবিত্ত
বাঙালি পরিবারে তার কদরই ছিল আলাদা। আজকের মোবাইলের সে কৌলীন্য কোথায়? দামি হ্যান্ডসেট, বা তার জন্য ভালো কভার কেনার মধ্যে
গৃহিনীপনার ছাপ খুঁজে পাই না। আসলে মধ্যবিত্তের সৃজনশীলতার অভিজ্ঞান তার
গৃহিনীপনা।
জ্যাঠা যেমন, ফোন রাখার জন্য আলাদা করে কাঠের একটা ছোটো বাক্স বানিয়েছিল। যেটার ওপরে
একটা টেনে লাগানোর ঢাকা ছিল। কথা হয়ে গেলে, রিসিভার রেখে,
ওই ঢাকা টেনে আটকে দেওয়া হত। ধুলো থেকে বাঁচাতে এই কেরামতি।
বুবাইদাদার কাজ ছিল, সপ্তাহান্তে এক বার অন্তত রিসিভারটা
ডেটল-জলে তুলো ভিজিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া। কারোর বাড়িতে ফোন ঢেকে রাখার জন্য আলাদা
তোয়ালে কিনে আনা হত। ফোনের জন্য আলাদা টেবিলও বরাদ্দ করা হত। সেখানে একটা পেনদানি,
হাতে তৈরি ছোটো প্যাড আর অবশ্যই টেলিফোন ডিরেক্টরি থাকত। কথা শেষ
করে ঠিক মতো তোয়ালে দিয়ে রিসিভার না ঢাকা হলে মা-র কাছে ভর্ৎসনাও জুটতো।
পাড়ায় কারো-কারোর বাড়িতে ‘প্যারালাল কানেকশন’ নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। সে কী
মহার্ঘ্য ব্যাপার। জানিস, “মৌ দিদিদের বাড়িতে ফোন এলে ওপর –
নীচ দু’জায়গা থেকেই ধরা যায়,” বিকেলে খেলার মাঠে বলল এক জন। অন্য জনের উত্তর, “জানি,
বাবাকে বলেছিলাম, কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। না
হলে আমাদের বাড়িতেও থাকত।”
তবে ‘প্যারালাল কানেকশন’ যে সব সময় বাড়ির লোকের [বিশেষ
করে বুবাই দাদা বা মৌ দিদির মতো ছেলে মেয়ের] পক্ষে সুখকর হত না, তা বোঝার মতো বয়স হয়নি তখনও। এ নিয়ে একটা ‘কেলো’-র কথা মনে পড়ছে। মা-কে জেম্মা বলত। এখনও সে সব মনে আছে। তখন না বুঝলেও এখন
বেশ বুঝতে পারি সে সব কথার গূঢ়ার্থ ।
কখন তোমার...
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
কথার মধ্যে কথা এসে পড়ল। কথা
শুরু হয়েছিল, আমার
চার পাশ কী ভাবে বদলে গিয়েছে, তা নিয়ে। খুব ছোটো ছোটো দু’টো উদাহরণ দেব বলেছিলাম। তার একটা-
টেলিফোন- নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। ল্যান্ড লাইনে জীবনের প্রথম প্রেম করার অভিজ্ঞতা
অনেকেরই আছে। যেমন ছিল,
মৌদিদির। আর তাই নিয়ে কম কেলো হয়েছে? সে
কথাটা এ বার ফাঁস করি। নিজের মেয়ের গুণপণার কথা তো পাড়া-ঘরে সবাইকে আর বলা যায় না।
যার সঙ্গে যার বেশি সখ্য সে-ই জানবে। তার কাছ থেকেই নেওয়া হবে পরামর্শ। এ ভাবেই
মাকে জেম্মা বলেছিল কিছু কথা। আমি শুনেছিলাম।
কিছুই না। ওদের বাড়িতে সময়ে, অ-সময়ে ফোন
আসত। একটা বা দু’টো
নিখুঁত রিং। ব্যস, কেটে
যেত। এমনি ভাবে বেশ কিছু দিন চলার পরে জেম্মা দেখল- যখনই রিং হয়, ফোনের কাছে
মৌদিদি ঘোরাঘুরি করে। কখনও ফোন কানে তোলে। ‘হ্যালো, হ্যালো’ করে রিসিভার
কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আর বিড়বিড় করে বলে, ‘কী রে বাবা, কথা বলে না
কেন?’' কথা
কিন্তু হয়। খুব ফিসফিসিয়ে। ওই রিসিভার ছাড়া সে কথা এতো দিন জানত না কেউ।
এক দিন হয়েছে কী, মৌদিদির বদলে
জেম্মা ফোন ধরে মেয়ের মতো গলা করে দু’বার ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছে। অমনি
উলটো দিক থেকে, ‘কী
করছ’? গোছের সদ্য প্রেমিকের ইন্ট্রো এসে
গিয়েছে। ব্যস আর যাবে কোথায়? জেম্মাও
ঝানু জিনিস। এ ভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে বুঝে গেল, মেয়ের
কীর্তি। কিছু বলল না। এর পরে দিন দু’য়েকের ‘অবজারভেশন’। অর্থাৎ, যেই না রিং
বাজে, মৌদিদি
ওপরে থাকলে জেম্মা নীচে। মৌদিদি নীচে থাকলে জেম্মা ওপরে। কানে ‘প্যারালাল
ফোন’।
এখন মনে হয়, সত্যি
জেম্মার ‘আন-প্যারালাল
টেনাসিটি’ ছিল[এর
একভাগও যদি পড়াশুনোয় লাগাতো...]। কাজেই, জেম্মার গল্পটা বুঝে নিতে বেশি দিন
লাগল না। আর যে-ই না বোঝা,
অমনি একদিন এলো চুলে মা-র কাছে এসে হাজির। কী ভাবে মেয়েকে বেঁধে রাখা যায়? মা যতই বলে, ‘বৌদি এ ভাবে
কিছু হবে না, বরং
উলটো ফল হবে।’ কে
কার কথা শোনে? খালি এক কথা বলে যাচ্ছে। ‘ওকে বুঝিয়ে
ছাড়ব। ফোনে হাত দেওয়া বারণ করে দেব। আমার চোখকে ধুলো দেওয়া?’' ধুলো তো আর
চোখকে দেয়নি। দিয়েছে কান-কে। কে কার কথা শোনে?
তার পরের এক সপ্তাহ মৌদিদি
বাড়ির বাইরে যায়নি, তা
খেয়াল করেছিলাম। কিন্তু বাড়ির মধ্যে যে কী হয়েছিল তা জানতে পারিনি।
তবে একটা কথা বেশ মনে আছে, তার পর থেকে
ওদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে একটা, কী দু’টো রিং বেজে ফোনটা আর থেমে যেত না কখনও।