কিছু কিছু শব্দ আছে, যা আমাদের
মনে আসে কিছু বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে। আর কখনও সেই সব অর্থের দ্যোতনা অনেক ভুলে যাওয়া
কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রায় ভুলতে বসা একটি শব্দ আর তার ব্যঞ্জনা-এই নিয়েই এ বারের
বুলবুল ভাজা।
ছবির উৎসঃ লিঙ্ক |
ব্যক্তিগত কিছু কাজ নিয়ে আমার
জেলার একটি গ্রামে গিয়েছিলাম আমারই এক বন্ধুর বাড়ি। আমাদের ওই বন্ধুটির আদি বাড়ি
ওই গ্রামে। তবে গ্রাম বলতেই যে ভারতের ছবি ভেসে ওঠে, ঠিক সে রকম গ্রাম এটা নয়। এখানে বাস
চলে। একটা পাকা রাস্তা আছে। আছে একটা হেলথ সেন্টার। গেলেই বোঝা যায়,
আমার বন্ধুটির গ্রামটি বেশ
সমৃদ্ধ। একে বর্ধিষ্ণু গ্রামই বলা চলে। ওই বন্ধুটির বাড়িতে এক সময় স-ব ছিল।
হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে
ঘোড়া। স-ব। এর পরে আস্তে আস্তে জমিজমা ফুরোতে লাগল। ঠিক যেমন কর্পূর মাটিতে খোলা রেখে
দিলে শেষ হয়, কতকটা
তেমনই।
এক সময় যে প্রচুর ছিল, এখন পুঁজি
বলতে কেবল পেটের বিদ্যেটুকু, সেটা ওদের বাড়ি গেলেই বোঝা যায়। ওর বাড়িতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে
সব দেখছিলাম। আর এই সব কথাই হচ্ছিল। ফিরে ফিরে আসছিল ‘জলসাঘর’-এর কথা।
এমনিই কথা বলতে বলতে ও একটা
জায়গায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। মাটির উনান। সামনের দেওয়াল, আশপাশ কালি
পড়ে রয়েছে। বলল, এখানে
ভিয়েন বসত। আমিও দেখেছি। ছোটো বেলায়। দুর্গা পুজোর সময়। তখন আমার ঠাকুমা বেঁচে
ছিলেন। তাই বলা মাত্র বুঝে নিতে অসুবিধে হল না। হঠাৎ করে ‘ভিয়েন’এল তার
বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে।
ও বলছিল, লক্ষ্মী
বিদের গপ্প।
ছবির উৎসঃ লিঙ্ক |
লক্ষ্মী বিদকে ছোটো বেলায় ওরা
মিষ্টি দাদু বলে ডাকত। বাড়িতে মিষ্টিদাদুর ডাক পড়া মানে বাড়িতেই হাজার রকমের
মিষ্টি তৈরি হবে। ভিয়েন বসবে। ইয়া বড় পাশ-বালিশের মতো চমচম। ঘি-য়ে ভাজা ল্যাংচা।
চাঁছির বিবিধ মিষ্টি। মিষ্টিদাদুর কাছেই ওরা শুনেছে, বড় জ্যেঠুর বিয়ের সময় কেমন চার দিন
ধরে ভিয়েন বসেছিল। যে যেমন মিষ্টি পছন্দ করেন, পাবেন। এলাহি ব্যাপার। ভিয়েন ঘরের ওই
কালি বুঝি তখন থেকেই জমে জমে এত দিন ধরে মিষ্টিদাদুর কথার সাক্ষী সেজেছে। কে জানে?
মিষ্টিদাদু গ্রামে এখনও আছেন।
আছে তাঁর দোকানও। টিম টিম করে চলে। গাঁয়ে এখন মুদির দোকানে হলদিরামের প্যাকেটের
মিষ্টি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় লাড্ডু। গজা। তবে সে সব কখনওই মিষ্টিদাদুর হাতে গড়া
মিষ্টির ধারে কাছে যেতে পারে না। সে কথা আমার বন্ধু জানেন। আমি জানি। আর আপনি
জানলেন।
ছবির উৎসঃ লিঙ্ক |
ঠিক আমার বন্ধুটির বাড়িতে
যেমন ভিয়েন-ঘর কালি ঝুলি মেখে চুপ মেরে বসে রয়েছে, তেমন-ই লক্ষ্মীদাদুর দোকানও দিন দিন
যেন মিইয়ে যাচ্ছে। খুব অল্প মিষ্টি তৈরি হয় আখার আঁচে। সব বিকোয় না। পরের দিন আবার
দোকান খোলেন দাদু। গেলেই গপ্প করেন। বড় বড় ভিয়েন বসানোর গপ্প।
গপ্পের ভিয়েন রোজ বসে।
গপ্পের মিষ্টি ভালই বিকোয়।
ক্রমশ...