টিভি আসবার পর থেকেই জীবনটা
বেশ বদলে গেছে আমাদের,
তাই না? মানে
বলা
ভাল কেব্ল টিভি আসার পর থেকে। হরেকরকম নাচ-গান, খেলা, মুখরোচক সম্-আচার (সমাচার বলতে আমার আপত্তি আছে), গেম-শো আরও কত কি! আরামকেদারায় বসে চায়ের কাপ হাতে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করে ফেললাম বেশ টিভির পর্দায়, কিংবা ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’-র মতো কেক-কফি সহ বিছানায় শুয়ে সচিনের তুলকালাম
ভাল কেব্ল টিভি আসার পর থেকে। হরেকরকম নাচ-গান, খেলা, মুখরোচক সম্-আচার (সমাচার বলতে আমার আপত্তি আছে), গেম-শো আরও কত কি! আরামকেদারায় বসে চায়ের কাপ হাতে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করে ফেললাম বেশ টিভির পর্দায়, কিংবা ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’-র মতো কেক-কফি সহ বিছানায় শুয়ে সচিনের তুলকালাম
ব্যাটিং টা উপভোগ করলো ইডেনের
টিকিট না পাওয়া কলকাতাবাসী। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এসব আর নতুন নয়।
এতদূর তাও ঠিক ছিল, গোলমাল করল
চব্বিশ ঘণ্টার সংবাদ পরিবেশকেরা (আজ্ঞে না, বিশেষ কোন চ্যানেলের প্রতি আমার
ইঙ্গিত নয়, হাতি
কাদায় পড়েছে বলেই তাকে লাথি মারা এই চামচিকের অভ্যেস নয়)। মানুষের জীবন এখনো এতটাই
ঘটনাবহুল হয়ে যায়নি যে প্রতি মিনিটে নতুন সংবাদের ‘জন্ম’ হবে। কাজেই যত পারো একটি বিষয়েই গোল
পাকাও। এই নিয়ে প্রথম নজরকাড়া গন্ডগোলটি দেখা দিলো বিলেতের বিবাহবিচ্ছিন্না
যুবরানীর দুঃখজনক মৃত্যুর পর। বিচ্ছেদের পর রাজবধূ নাকি যার তার সাথে প্রেম করে
বেড়াচ্ছেন- অতএব লেগে পড়ো তার সেই ব্যক্তিগত জীবনের অলিগলির খবর জানাতে, আক্ষরিক
অর্থেই তাড়া করে তাকে একরকম হত্যাই করলো সংবাদমাধ্যম। কেচ্ছার নয়, নিজের
মৃত্যুর সংবাদ supply
করে মুক্তি পেলেন তিনি।
শুরু হয়েছিলো পায়রার পায়ে
চিরকুট বেঁধে, তারপর
ঢেঁড়া দেওয়া, রাজদূত, বেতার হয়ে
বহুদিন কেটে গেছে। আজ স্যাটেলাইট ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির পর গোবিন্দা থেকে
গোবিন্দ- ক্যামেরার অধরা নন কেউই। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে রবীন্দ্রসরোবরে প্রেম
করছে অনামী যুগলে, ঝট
করে তার ছবি তুলে অপসংস্কৃতির ওপর একটি ‘স্টোরি’ করে ফেললেন
উঠতি সাংবাদিক। তাদের কপালে এরপর কি জুটলো?- সেটা আলাদা ‘স্টোরি’। বেশ মনে
আছে একটি পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পর
সংবাদমাধ্যম মশলাদার খবরের খোঁজে হানা দেয় তাদের প্রত্যেকের বাড়ীতে। এমন প্রশ্নও
করে “আচ্ছা, এই ঘটনায়
আপনাদের কেমন লাগছে?”
মৃতদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবেরা আজও ‘পাবলিক’কে
আনুষঙ্গিক অপপ্রচারের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত- সৌজন্যে ‘ব্রেকিং
নিউজ’। আজকাল বরং দেখা যাচ্ছে সেলিব্রিটিরাই একটু আরামে আছেন। হালে ক্যামেরার প্রধান
শিকার আমজনতাই। মুম্বই-এর সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।
আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় জঙ্গিদের হাতে পণবন্দী ছিলেন দীর্ঘ দু’দিন। তারপর
তিনি ছাড়া পেয়েছেন। আমাদের আত্মীয়তার খবর পেতে একটু দেরি হয় ‘খবরি’দের। কিন্তু
কে না জানে better
late than never, তাঁরা সদলবলে এলেন, বাড়ির টিভি চালালেন, বাড়ির
লোকেদের অনুমতির অপেক্ষা না করেই জিনিসপত্র অগোছালো করে তুললেন। তারপর বাড়ির
লোকজনকে বললেন “খুব
চিন্তিত মুখে কপালে হাত দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকুন...” (মানে
পণবন্দী স্বজনের জন্য চিন্তিত বোঝানো দরকার তো, তাই আর কি!) খবরের নাট্যরূপ বোধহয়
একেই বলে- আক্ষরিক অর্থেই! প্রসঙ্গটা আরেকটু টানলে জানাতে পারি, সেই দীর্ঘ
কয়েকদিনের চাপা উত্তেজনার ফলে কিছুদিন পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আমার সেই
আত্মীয়ের বাবা, সে
খবর জানে না দিল্লি,
ইসলামাবাদ কিংবা সেদিনের সেই ‘ডিরেক্টর’ সাংবাদিক।
দেখা যাক, এই নতুন
ধরনের সাংবাদিকতায় তাহলে কি পেলুম আমরা? নিট ফল কি সত্যিই শূন্য? আজ্ঞে না, লুকনো
ক্যামেরার কাছেই ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা
পড়েছিলেন রাজনৈতিক নেতা, গদিটি হারান তিনি। বিরোধী নেত্রীর নামে ছাপার অযোগ্য ভাষা
প্রয়োগ করে দুর্নাম কুড়োলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাম্যবাদী নেতা- তাও এই ব্রেকিং নিউজের দৌলতেই। বক্তব্য
প্রকাশ করে তা থেকে সরে দাঁড়ানোর মহান পরম্পরায় ভাটা পড়েছে এই ‘live TV’র
দাক্ষিণ্যেই। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে পাচ্ছি সকলে-
টিভি আছে বলেই না? এতো
গেলো ‘ঘটনা’র কথা, আর যখন ঘটনা
না ঘটে? তখন
? তখন
হয় ওই পুরোনো ঘটনাতে রঙ মাখিয়ে নতুন মোড়কে পরিবেশন, নয়তো নতুন ঘটনার ‘জন্ম’ দেওয়া। জন্ম
দিতে গেলে ডেলিভারি সংক্রান্ত কিছু হসপিটালের খরচ তো আছেই, সেই কারণেই
দু’মিনিট
অন্তর ............“অমুক
বিস্কুট নিবেদিত সংবাদ শিরোনাম। মুচমুচে আর দারুণ” পরবর্তী বাক্যে হয়তো শুনতে পাবেন
ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনার খবর। সেটিও বেশ মুচমুচে, কারণ নিহত-আহতের চেয়ে সেই “স্টোরি” তে অনেক
বেশী করে থাকবে অন্য উপ-সংবাদ। যেমন কোন মন্ত্রী সেই দুর্ঘটনাস্থলে না গিয়ে
পার্টিতে গিয়েছেন, সেই
পার্টিতে কোন নায়িকা লাস্য পরিবেশন করলেন, আর তাই নিয়ে অমুক দাদা ঠিক কি ভাষায়
বিষোদ্গার করলেন। ব্যস্,
আপনার জন্য আগামী দু’ঘন্টার
ঝালমুড়ি তৈরি, খান
আর ভুলে যান ঝলসে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া রেলের কোচের কথা। শুধু হাত ধুতে উঠবার সময়
লিপস্টিক হাসিতে টিভির পর্দা থেকে ভেসে আসা অনুরোধ মনে রাখুন “ফিরে আসছি
একটা ছোট্ট বিরতির পর......সঙ্গে থাকুন”। সেদিন এই নিয়ে স্পষ্টত বিরক্তি
প্রকাশ করলেন এক সদ্য-মুখ্যমন্ত্রী। অনেক মনে না রাখার মতো মন্তব্যের মধ্যে একটি
কথা ছিলো যে মুখ দেখানোর সুলভ সুযোগ করে দিয়ে প্রশাসনের কাজ বাড়িয়ে তুলছে মিডিয়া।
কথাটি ভেবে দেখার মতো। শেষে একটি মজার প্রসঙ্গে আসা যাক, প্রাচীন এক
ধ্বংসাবশেষ নিয়ে শতাব্দী-প্রাচীন কাজিয়ার মীমাংসা হওয়ার কথা ছিলো সেদিন, আদালত চত্বর
সরগরম। ক্যামেরা এবং তার মালিকেরা প্রস্তুত হয়ে আছেন একটি মনে রাখার মতো
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা ও দেখানোর জন্য। তার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই অনুরূপ
পরিস্থিতির আশঙ্কা (নাকি প্রবল আশা) প্রচার করে চলেছেন তারা। তারপর রায় বেরোল, কোন পক্ষই
খুব একটা সন্তুষ্ট নয়,
কিন্তু হায় কেউই যে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা বললো না! লোকজন সব ভেড়া হয়ে
গেলো নাকি? না, না, এমনটা তো
হতে দেওয়া যায় না। প্রশ্ন এলো “এই রায়ে আপনি বা আপনারা কি বঞ্চিত বোধ করছেন?” প্রায় একশো
শতাংশ ক্ষেত্রে উত্তর এলো “মহামান্য
আদালতের রায় মাথা পেতে নিলাম”। মরণ আর কি! সবাই যদি সব মাথা পেতেই নিবি, তাহলে আমরা
আর মাথা গুঁজি কোথায়?-
এখনো মনে পড়ছে প্রশ্ন করাকালীন অল্পবয়সী, সুশ্রী রিপোর্টারের শুকনো মুখটা। ওই
যে প্রথমে বলছিলাম না সম্-আচারের কথা, তা আচার ভাতের সাথে এট্টুখানি হলেই
চলে। মানুষের পেট ভরে ভাতেই, আচারে নয়।