যে দু’একটা কাজ
অল্প অল্প করতে পারি বলে আমার ধারণা, তার একটা আজ করার চেষ্টা করব। সেটা হ’ল সিনেমার
গল্প বলা। কাজটা কঠিন নয়, তবে ইচ্ছে আছে গল্পের সঙ্গে অন্য একটা কাজও করার। সে কথায় পরে আসছি। যে সিনেমার কথা আজ বলব, সেটা হয়তো অনেকে দেখেছেন। যদি জানতে ইচ্ছে করে সিনেমার ‘রেটিং’, জ্ঞানীজনের ‘রিভিউ’, তবে এখানে দেখে লাভ নেই। আমি সে সবে যাব না, যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। আমি শুধু নিজের মতো করে গল্প বলবো। যারা দেখেননি, তাদের একটু কষ্ট করে ছবিটা দেখতে বলবো। যারা দেখেছেন,
তারাও যদি লেখাটা পড়ে ছবিটা আর একবার দেখতে চান, তবে লেখা সার্থক মনে করবো।
গল্প বলা। কাজটা কঠিন নয়, তবে ইচ্ছে আছে গল্পের সঙ্গে অন্য একটা কাজও করার। সে কথায় পরে আসছি। যে সিনেমার কথা আজ বলব, সেটা হয়তো অনেকে দেখেছেন। যদি জানতে ইচ্ছে করে সিনেমার ‘রেটিং’, জ্ঞানীজনের ‘রিভিউ’, তবে এখানে দেখে লাভ নেই। আমি সে সবে যাব না, যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। আমি শুধু নিজের মতো করে গল্প বলবো। যারা দেখেননি, তাদের একটু কষ্ট করে ছবিটা দেখতে বলবো। যারা দেখেছেন,
তারাও যদি লেখাটা পড়ে ছবিটা আর একবার দেখতে চান, তবে লেখা সার্থক মনে করবো।
এক উৎসাহী, সরল মুখের ‘Cello’বাদক
(দিব্যি বড়সড় বেহালার মত দেখতে একটা যন্ত্র), সদ্য সুযোগ পেয়েছে কনসার্ট-এ
বাজানোর। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো জানতে পারে যে তার দলটা ভেঙে দেওয়া হ’ল। ঘরে তার
মিষ্টি বউ। নিজের স্বপ্নের সমাধির দুঃখকে যদিও ছাপিয়ে যায় শেকল কাটার আনন্দ, (‘চেলো’ টা বিক্রি ক’রে) তবু
কুন্ঠাবোধ ক’রে ‘Web-designer’ বউকে
দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে। কিমাশ্চর্যমতঃপরম্! বউ প্রায় আমাদের
দেশের সিরিয়ালের ‘বহু’দের মতো এক
কথায় রাজী হয়ে যায় নিজের কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেটার সঙ্গে চলে যেতে।
(এইটুকুতেই মেয়েটার প্রেমে পড়বেনা, এমন বাঙালি ছেলে বিরল, তায় বড্ড মিষ্টি
দেখতে!) দেশে ফিরে শুরু হয় চাকরির চেষ্টা, আর প্রথমেই চোখে পড়ে এক কোম্পানির
বিজ্ঞাপন, যা
দেখে মনে হয় বোধহয় ট্রাভেল কোম্পানি। ছেলেটি দেখা করতে গেলে হবু ‘বস্’ ইন্টারভিউয়ের
নামে যা করলেন, তা
এদেশে হামেশা বন্ধুর ছেলেকে চাকরি দিতে করা হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে ছেলেটির সাথে
আমরাও জানতে পারি, কি
এক অদ্ভুত কাজে জড়িয়ে পড়েছে সে।
কি? এই অবধি
শুনে মনে হচ্ছে না, যেন
আমার-আপনার গল্প হলেও হতে পারে? না,
তা ঠিক নয়। এর পরই আসবে এক চমক। জাপানী সিনেমা। বড় বড় নাম জড়িয়ে সিনেমার
সঙ্গে। জাপান নামটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যে নিয়মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, তার সঙ্গে
এই গল্পে জুড়েছে সেই দেশের এক ধুঁকতে থাকা, অবহেলিত কিন্তু প্রায় শিল্পের
পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া পেশার গল্প- যার বিবরণ ছবির বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির
মতই বিষণ্ণ অথচ অপরূপ।
‘Okuribito’/ ‘おくりびと’ (ইংরাজী প্রকাশে নাম ‘Departures’,
যদিও ইন্টারনেট মহাগুরুর মতে নাম হওয়া উচিত ছিল ‘He who
sends’) আমার দেখা প্রথম সিনেমা, যেখানে
মৃত্যু, গল্পের এক শান্ত-শিষ্ট পার্শ্বচরিত্র। সেভেন্থ সিল
সিনেমার মত personified নয়, কিন্তু কখন
যে ঠিক আমাদের পাশে বসে বন্ধুর মতো সেও দেখতে শুরু করেছে সিনেমাটা, বোঝাই যাবেনা। কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরে এই ছবি, ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা স্নিগ্ধ হাসির মধ্যে। শুধুই কি মৃত্যু? তার
সামনে দাঁড়িয়েই কি সবচেয়ে বেশি করে বুঝিনা আমরা, কত জোর দিয়ে
বেঁচে আছি? এক স্নানঘরের বিধবা মালকিন আর তার প্রয়াত স্বামীর
বন্ধুর মধ্যে যে মিতবাক সম্পর্ক, তাকে কি বলবেন আপনি?
ভালবাসা, বন্ধুত্ব, নির্ভরতা?
জগৎ জুড়ে সব সম্পর্ক শেষে মরণের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়। শেষের সে
দিনের কত রূপই না দেখালেন আমাদের পরিচালক! চলে যাব জানি সকলেই, তবু মৃত্যুর উঠোনে একচক্কর ঘুরে এলে আমরা কি ধন্যবাদ দিইনা ভাগ্য কে,
যে আমার প্রিয় এখনো আমার চোখের সামনে? নায়কের
ঘরে ফিরে নায়িকাকে আকুল জড়িয়ে ধরা, আর বার বার শরীরে জীবনের
গন্ধ নেওয়ার দৃশ্য- কখনো ভোলা যাবে কি? ভোলা যায়, আবেগঘন এক দৃশ্যের পর ‘বস্’ এর
নির্বিকার খাওয়ার দৃশ্য? মৃত্যু-নির্ভর ব্যবসা যার, তাঁর নিজের মনে ঠিক কি চলে? প্রাণীদেরও বাদ দেননি
পরিচালক। কখনো মৃত অক্টোপাস হয়ে দাঁড়ালো মৃতপ্রায় কেরিয়ারকে বাঁচানোর ব্যর্থ
প্রচেষ্টার প্রতীক, কখনো প্রজনন-সফল নির্ভার Salmon এর দেহ পাহাড়ি জলে বয়ে গিয়ে এক ছবিতে তুলে ধরলো হাজার কথা। প্রকৃতির রূপ
পরিবর্তন হয়েছে গল্পের mood কে ঘিরে। যে গল্প শুরু হলো
অন্ধকার তুষার-পাতের মধ্যে, তার-ই শেষে ফুল ফুটলো গোটা
জাপানে- মনের অস্থিরতা ভুলে দাইগো কোবায়াশির মতো আমরাও মেনে নিলাম যে জন্মের মত,
মুছে যাওয়াটাও জীবনের একটা তুচ্ছ সত্য, যতই সে
আমাদের ভীত-মানসে অনুভূতির প্লাবন ডেকে আনুক না কেন। এর সাথে যোগ করুন দক্ষ
শিল্পীর আঁচড়ে মানব-মনের হাজার একটা খেলার পাঁচ-মেশালী স্যালাড আর জীবন-ভর বহন করা
অভিমানের catharsis-এসব মিলিয়ে যে বিজয়ী ফর্মুলা তৈরী হলো,
তার ক্ষমতায় সন্দেহ করে কার সাধ্যি?
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
আজ অবধি যত জনকে সিনেমাটা
দেখিয়েছি- অবধারিত ফল- চোখ জুড়ে জল অথচ মুখে একটা শিশুর মত বোকা হাসি (সেটা বুড়ো
বয়সে কাঁদার লজ্জা ঢাকতে নাকি অমোঘ সত্যের সামনে নিজেকে শিশু হিসেবে আবিষ্কার করার
আনন্দ, বলতে
পারবো না)। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। এতেই শেষ নয়? আরো কারণ
চাই দেখার? তবে
বলতে হয় মরমী নেপথ্য-সঙ্গীতের কথা, মনে আছে গুনগুন করেছিলাম একটা গোটা
দিন। মাপা অভিনয়, ঝকঝকে
সিনেমাটোগ্রাফি, মেদহীন
চিত্রনাট্য আর- আর- ও হ্যাঁ! খুব মিষ্টি এক নায়িকা! ওই যে ‘অগ্নীশ্বর’ সিনেমায়
উত্তমকুমার বলেছিলেন না,
“আপনি তবে পাঁজি পড়ুন”?
আমাকেও তবে বলতে হবে,
এতকিছুর পরেও ভাল না লাগলে বাপু ‘দাবাং’ দেখো।
সমালোচনা? খারাপ কিছু
লাগেনি কি? সত্যি
বলতে পরিচালক ‘ইয়োজিরো
তাকিতা’ অনুভূতি
নিয়ে এত খেলেছেন সিনেমায়,
যে প্রথমবার দেখার সময় সে সবের কথা ভাবতেই পারিনি। তবে নেহাত খুঁত ধরতেই যদি
হয়, বলবো
পুরষ্কারের লোভটা সিনেমার অনেক জায়গায় ফুটে উঠেছে। শেষের দিকে কিছু অংশ না হলেই কি
হত না? (যদিও
ওই সব জায়গাতেই বেশি ফ্যাচ ফ্যাচ শোনা যাবে সম্ভবত!) সত্যি বলতে জীবনের অনেক শক্ত
দিক সুন্দর করার জন্য পরিচালক ঝাপসা করে দেখিয়েছেন- অনেকটা আমাদের ‘বলিউড’ ‘জীবনমুখী’ ছবি করলে
যেমন হয় আর কি।
না দেখে থাকলে দেখে ফেলুন।
ঠকবেন না। যাওয়ার আগে বলে যাই, যারা জানে না তাদের জন্য- এই ছবি ২০০৯ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশী
ছবির অস্কার পেয়েছিল,
ফেভারিট ‘Waltz
with Bashir’কে হারিয়ে।