১
ফাঁকা মিনিবাস। সাড়ে বারোটা
নাগাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে বড় জোর পাঁচ সাত জনই ওঠে। আমার পছন্দের বসার জায়গাটা ঠিক
লাস্টের আগের সীটটা। বাস পুরো ফাঁকা। পাগলামো করতে আপত্তি নেই। বেশ হাত টাত দুলিয়ে
নাচের ভঙ্গিতে ঠিক করলাম আজ বাঁ দিকে বসব। কাঁধের টি, কন্টেনার, ঢাউস
একটা ব্যাগ গুছিয়ে টুছিয়ে যখন বসলাম, এমা!, দেখি একজোড়া
চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। নিশ্চয়ই মনে মনে আওয়াজ দিচ্ছে – পাগল কত
রকমের হয়! লজ্জা পেলাম। তারপর যথারীতি নিজেকে বললাম- বেশ করেছি! কিন্তু... চোখ
দুটো ভীষণ সুন্দর ছিল যে... কোথায় নামল... ধুর যা ভিড় হয়ে গেল... আর দেখাই গেল না।
২
বাকি সব ভালই চলছিল কিন্তু
রমেনদা’র
গান আর শোনা হয় না। আগের বছর ভাল ছেলে ছিলাম তো, ন’টার
বাসেই যেতাম। বসার জায়গা না পেলে রমেনদা গলা ছেড়ে গাইত। না না, খারাপ
গাইত এ কথা শত্রুও বলবে না, তবে বসতে পেলে কেন গাইত না তা কেউ
জানে না। আর নাড়ুকেও আর দেখি না, ও একবার ফিমেল কে ফ্যামেলি পড়েছিল
তাই ওকে সবাই ‘ফ্যামেলি
ম্যান’ বলে
ডাকত। তাছাড়া রমেনদার অত্যাচারের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া গেছে। যেদিন বাসে ওঠার আগে
ওর দিকে তাকিয়ে হাসতাম সেদিন আমার ভাড়াটা আগে থেকে কেটে রাখত, প্রথমে
তো দারুণ লাগত,
কিন্তু রোজ রোজ এটা হলে কেমন লাগে তা সে যার সাথে হয়েছে সেই জানে। পরে অবশ্য
একটা ফালতু উপায় কাজে লাগিয়েছিলাম, তবে সেটা ফালতুই, ওকে
দেখলে আর চিনতে পারতাম না।
৩
এসব তো গেল পুরনো কথা, নতুন
কি? নতুন
হল একজোড়া চোখ,
একটা বাঁ হাত, যাতে ঘড়িটা ভেতর দিক করে পরা আর সেই দিকেই একটা ছোট্ট জড়ুল।
সে এক দারুণ ব্যাপার, রোজ অপেক্ষা করে থাকি, যদি আজ দেখা
পাই। পেলাম আর দু’এক বার। হিসেব টিসেব করে দেখলাম- হাজরাতে নামা মানে আশুতোষ
কলেজ, আর
এই সময় ক্লাস চলছে মানে হয় সেকেন্ড না তো ফার্স্ট ইয়ার। তো, মুখে
একগাল হাসি নিয়ে স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন দেখব, স্বপ্নই
দেখব। জানি বাস্তবে কিছু হবে না। কারণ তিনটে। এক আমার চেহারা, দুই
আমার সাহস নেই,
তিন এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা প্রচুর, মানে এমন
স্বপ্ন আমি আগেও অনেক দেখেছি। কিন্তু সমস্যাটা দাঁড়ালো অন্যখানে, মেয়েটা
ঝাড়ি মারছে!!! মানে গোদা বাংলায় তো একে ঝাড়ি মারাই বলে। আমি তো অবাক। আমার দিকে
একজন তাকাচ্ছে?
মানে,
আমার দিকে একটা মেয়ে তাকাচ্ছে? মানে, আমার
দিকে একটা সুন্দরী মেয়ে তাকাচ্ছে? আমার দিকে? আশ্চর্য!
৪
আমি লাস্টের আগের সীটে বাঁ দিকে। আর একজন দরজার পেছনের
প্রতিবন্ধী সীটে। আমি চুপচাপ বসে লাজুক লাজুক দৃষ্টি। আর একজন বেশ বেপরোয়া। সীটের
কাছে এসে একবার,
পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে একবার, ব্যাগটা আবার তুলে বসার আগে একবার, বসার
পরে কি ছুতোয় পেছনে তাকিয়ে আরও একবার। একেই বোধহয় দৃষ্টিবাণ বলে! আমার বুকে
দুমাদ্দুম মুগুর, আর খুব চেষ্টা করে চেপে রাখা হাসি। না না, একেই
বোধহয় দাঁত কেলানো বলে!
হাজরা তে লোকজন নামিয়ে বাসটা যখন বাঁ দিকে বাঁকবে তখন সময় লাগলো
অনেকটা। বাসটা বাঁ দিকে ঘুরেই দাঁড়িয়ে পড়ল, জ্যাম হবে
হয়তো। আমি তো জানলার ধারেই। লাস্টের আগের সীটে বাঁ দিকে। একজন হাঁটছে। না না
হাঁটছে কই,
দুটো চোখ,
আমার দিকে,
এক দৃষ্টে,
অপলক,
এগিয়ে আসছে। আমার চোখের শালা এক্সপেরিয়েন্স কোথায়! একবার তাকাই, তো
দুবার নামিয়ে নি’। কিন্তু সেই চোখ দুটো... অমোঘ আকর্ষণ, যেন
ভরসা জোগাচ্ছে,
বলছে ভয় কি...? উৎসাহ দিচ্ছে।
মণিদা কে বলিনি। বললে বলত-
মেয়েছেলে! ছেলে হয়ে জম্মেছিস কেন! ডুবে মর শালা!
৫
আর এক দিন স্ট্যান্ডে বাস নেই
অনেকক্ষণ। লম্বা লাইন। রোদে দাঁড়িয়ে আছি। যদি আজ দেখা হয়। ধুস্, বাস
চলে এলো। বসার জায়গা নেই, কি মজা! পরের বাসটার জন্য আবার
দাঁড়াব। পেছনের কয়েকজন বলল কি হে যাবে না? আমি সগর্বে
শুনিয়ে দিলাম বসেই যাব, হোক দেরি। বাস ছেড়ে দিল আর অমনি উনি
হাজির, আমার
সামনে থেকে দু’তিন
বার ঘুরে লাইনটা একটু জরিপ করে অটো তে উঠতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে একবার হালকা করে
তাকিয়েও দিয়ে গেলেন। চোখে করে বলে দিয়ে গেলেন, তাড়া আছে, আর
আজ যখন দেখাটা হয়েই গেল তো অটো তে গেলে হয় না? পরিষ্কার
ইনভিটেশন। যাব ভেবে পা বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। এতক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে আছি বাসে
বসে যাব বলে আর এত পরে একটা মেয়ের পেছন পেছন অটো তে চলে যাব! লোকে কি বলবে? আমার
একটা প্রেস্টিজ আর একটা রেপুটেশন আছে না?
৬
ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে।
কোথায় থাকে,
কি তার নাম,
স-ব জানতে হবে। অনেক দিন তো হল। মাসে দু’তিন বার
মাত্র দেখা হয়। বছর ঘুরতে চলল। খোঁজ খবর তো কিছুই নেওয়া হল না।
যেদিক থেকে বাস ধরতে আসে তাতে
বোঝা যায় আমার বাড়ির এক কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যেই থাকে। পাড়ায় আমার বন্ধু নেই
বললেই চলে,
তাও আবার এই রকম একটা ব্যাপার তো আর যাকে তাকে বলা যায় না। সবেধন নীলমণি হল
গিয়ে নিলয়। বললাম। কুণালকেও বললাম। ফর্সা মতো, বেঁটেখাটো, লম্বা
বেণী, নীল
লেডিবার্ড,
আশুতোষ কলেজ, বাঁ হাতে ছোট্ট জড়ুল। ছোটুদাও কোন সদুত্তর দিতে পারল না।
যেদিন দেবলীনার বাবা আমার
টিকিটটা করে দিলেন, সেদিন ঠিক গল্পের বইয়ের মতো বাসের টায়ার পাংচার হল।
কালীঘাটের একটু আগে। ভাবলাম আজ হয় এসপার না হয় ওসপার। আজ তো কথা বলতেই হচ্ছে। আমার
ভাগ্য তো! এর চাইতে ভাল আর কি হবে? দেবলীনার বাবা আমাকে ধরে মেট্রো
স্টেশন এ নিয়ে চললেন, বললেন কলেজে দেরি করতে নেই, সময়ে পৌঁছনো
একটা খুব ভাল অভ্যাস। বোঝো!
আর একদিন একটু সকালেই যেতে হবে কলেজে। এই সাড়ে
আটটা কি পৌনে নটা হবে। যাচ্ছি বাস ধরতে। হঠাৎ দেখা। উলটো দিক থেকে। কোচিং ফেরত
হয়তো। নীল লেডিবার্ড পাংচার। সাথে এক বান্ধবী। আর, চোখ সেই
আমার দিকে। অদ্ভু্ত একটা অনুভূতি হল। ঠিক বুঝতে পারলাম না চোখ দুটো ঠিক কি বলতে
চাইছে। চোখে কি একটু ঔদ্ধত্য ছিল নাকি অহংবোধ? নাকি বলছিল
তোমাকে তো বধ করেই ফেলেছি, দেখো আমার মহিমা। কেমন জানি ক্ষেপে
গেলাম। ভুরু টুরু কুঁচকে তাকালাম। যেন বলতে চাইলাম- ভদ্র ঘরের মেয়ে অত ঝাড়ি মারা
কিসের হে! আমি না তোমায় নিয়ে অন্য রকম স্বপ্ন দেখার কথা ভাবছি! চোখ দিয়ে বেশ জোরেই
একটা ধমক হয়ে গেল।
ব্যাপারটা সত্যিই বেশ জমে
উঠেছে।
৭
আমারই তো ভাগ্য না! পাক্কা দু
মাস আর দেখতে পাইনি। পরীক্ষার মরসুম, কি আর করা যাবে। ভেবেছিলাম অভিমান করবে, চোখের
ভাষাতেই মান ভাঙাবো। দূর দূর, তা হলে তো আমার লাইফ নিয়ে সিনেমা হত!
ছুটি চলছে। আমাদের স্কুল
গ্রুপের পিকনিক হবে। আমি আর অদিতি সেই বাস স্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে আছি। বনি আর নিলয়
আসবে তারপর একসাথে যাব। বিড়বিড় করে বলছিলাম আজ যদি দেখা হয়, আজ
যদি দেখা হয়। অদিতি বলল কার কথা বলছিস রে? আমি বললাম
তুই কি করে চিনবি? ওকে থামিয়ে দিলাম। কিন্তু পিকনিকে কথাটা পাড়লাম আমাদের
গ্রুপের মেয়েদের সামনে, যদি কেউ কিছু বলতে পারে। সব শুনে
টুনে জয়িতা হায় হায় করে উঠল, অদিতি কপাল চাপড়াল আর মধুশ্রী বলল
দেবু চোখ ধুয়ে আয়, আর কাউকে পেলি না? তুই আমাদের একবার জিজ্ঞেস করলি না?
মেয়েটি অদিতি মধুশ্রীদেরই
ক্লাস মেট। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে নাকি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। দু’ বছর
পরে ডিভোর্স। পুরোনো বন্ধুদের কারুর সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি।
রোখ চেপে গেল। কথা তো এবার
বলতেই হবে। ছোটবেলার ঐ ঘটনাটাকে আর কেউ না দেখুক আমি তো সামান্য একটা ভুল হিসেবেই
দেখব। কথা তো এবার বলতেই হবে। কারণ আমার ভুরু কুঁচকে ধমক দেওয়াটা ঠিক কি কারণে, সেটা
আমাকে জানাতেই হবে। দেবনারায়ণ বলল, মজা পাওয়া আর প্রেমে পড়া কিন্তু এক
জিনিস নয় দেবু। এখন ঘটনাটা জানার পর যদি তুই জোর করে প্রেমে পড়িস তো সেটা দয়া
দেখানো হবে,
আর সেটা একরকম ভাবে অপমান করা । তা সে যাই হোক কথা তো এবার বলতেই হবে।
৮
আমি লাস্টের আগের সীটে বাঁ
দিকে। আর একজন দরজার পেছনের প্রতিবন্ধী সীটে। আমি চুপচাপ বসে উৎসুক দৃষ্টি। আর
একজন... আর একজন অচেনা কেউ। চোখ দুটো একবারের জন্যেও আমার দিকে ফেরেনি। বড় শীতল
ভাষাহীন চোখ দুটো আমার দিকে না তাকিয়ে বলে দিল, ক্ষমা নেই।
অপরাধ করেছ। আমার বুকে দুমাদ্দুম মুগুর, আর খুব চেষ্টা করে চেপে রাখা চিৎকার-
আমি জানতাম না,
জানতাম না! কিন্তু বলতে যে হবেই, বলতেই হবে। একবার শুধু একবার তাকাও
আমার দিকে...