আমার আজকের বিষয় একটু
বিজ্ঞানভিত্তিক। না না, মানবসমাজে বিজ্ঞানের অবদান বর্ণনার
জন্য এই লেখা নয়। তার জন্য তো ছোটবেলার বিভিন্ন রচনা বইয়ের নানান রচনা আছেই। আমি
আরেকটু বড় হয়ে বিজ্ঞানের দিগন্তবিস্তৃত শাখা-প্রশাখার মধ্যে থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র
বিষয়টিকে তুলে ধরতে চাইছি। অবশ্য চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়টিও নেহাৎ ক্ষুদ্র নয়। তারও
অসংখ্য ডালপালা। প্রতিটি প্রশাখায় বিচরণ না করে বরং একটু ‘to the point’ হওয়া যাক। আমার বক্তব্যের কেন্দ্রে
আছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেটির ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনস্বীকার্য।
শাখাটির নাম ‘Oncology’। সকলের
সুবিধার্থে একটু বর্ণনা করলে বলতে হয় এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে
কোনো রোগীর দেহে ক্যান্সার, টিউমার প্রভৃতি রোগের উপস্থিতি
নির্ণয়, তার
ভয়াবহতার মাত্রা পরিমাপ, তাকে প্রতিরোধের উপায় নির্ধারণ
ইত্যাদি পর্যালোচনা করা হয়। একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, এইরকমের
রোগে প্রতিবছর যতজন মারা যান সেটা ভারতবর্ষে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ এবং প্রতিবছর
এটা ১১% হারে ক্রমবর্ধমান। কাজেই আশা করি
পাঠকগণ শাখাটির গুরুত্ব ও চাহিদা উপলব্ধি করতে পারছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখাটি
সম্বন্ধে আমার মূল বক্তব্য শুরু করার আগে আমি পাঠকগণকে একটু অবহিত করতে চাই যে
আমার বক্তব্যের মধ্যে এই ধরনের মারণরোগগুলির উৎস সম্বন্ধে আমি কোনো আলোচনা করব না।
শুধু এইটুকুই বলব যে, যেকোনো সূত্র থেকেই আসা এই মারণব্যাধিগুলি অত্যন্ত
অবাঞ্ছিত। যাই হোক্, যেকোনো রোগের নিরাময় করার আগে, সেটা সাধারণ
সর্দি-জ্বর-ই হোক বা ক্যান্সার/টিউমার-ই হোক, প্রাথমিক
পর্যায় হল রোগটির সনাক্তকরণ। সর্দি-জ্বরের মত সাধারণ ব্যাধির প্রাথমিক পর্যায়ে
সনাক্তকরণ খুবই সহজ, কিন্তু ক্যান্সার/টিউমারের মত মারণব্যাধি, যেগুলির
প্রাথমিক সনাক্তকরণ খুবই দরকারি, সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে
না। হয়ে ওঠে না,
তার কারণ,
যে প্রাথমিক অবস্থায় এগুলো ধরা পড়লে খুব সহজেই হয়তো রোগগুলির নিরাময় সম্ভব সেই
প্রাথমিক অবস্থায় সেগুলো ধরা পড়ে না। একটু খুলে বলি, ধরুন কারোর
টিউমার ধরা পড়েছে এবং টিউমারটির আকার ~১ সেমি। হয়তো এই টিউমারটির আকার যখন
কয়েক মাইক্রো-মিটার (1 মাইক্রো-মিটার = ১০-৪ সেমি.) তখন যদি ধরা পড়ত, তাহলে
হয়তো রোগটির নিরাময় একটু সহজ হত। এখন স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের মনে হচ্ছে কেন ধরা পড়ছে না। এর দুটো
কারণ হতে পারে। প্রথমত, যে ধরণের লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ এই
ধরণের রোগগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় সেটা প্রাথমিকভাবে ধরা পড়ে না। এটা
দুর্ভাগ্যজনক। দ্বিতীয়ত, এটা হতে পারে যে লক্ষ্যণগুলো দেখা
যাচ্ছে, কিন্তু
ডাক্তারি পরীক্ষায় রোগগুলির অস্তিত্ব ধরা পড়ছে না। কয়েকটি ডাক্তারি পরীক্ষার নাম
নিশ্চয় অনেকেই শুনে থাকবেন, যেমন CT Scan, MRI Scan,
PET Scan ইত্যাদি। আমার বক্তব্যের একটি অংশ এই বিষয়টিকে নিয়ে, বিশেষত
“PET
Scan” নামক যে ডাক্তারি পরীক্ষাটি আছে তাকে নিয়ে।
প্রথমে খুব অল্পকথায় বলি
কিভাবে এই রোগগুলির সনাক্তকরণ করা হয়। আপনাকে প্রথমে একটি গ্লুকোজ খাওয়ানো হয়, যার
মধ্যে একটি বিশেষ রাসায়নিক থাকে। এই রাসায়নিকটি আপনার রক্তে মিশে গিয়ে যেখানে
যেখানে ক্যান্সার/টিউমার আক্রান্ত জায়গা পায় সেখানে বেশি করে জমা হতে থাকে।
কিছুক্ষণ বাদে আপনাকে একটি বিশেষ যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যেখানে আপনার
আক্রান্ত অংশগুলির একটি ছবি পাওয়া যায়। আপনার শরীরে আগে থেকেই ঢুকে থাকা সেই
রাসায়নিকটি এই ছবিগুলি তুলতে সাহায্য করে। এই ছবিগুলি দেখেই ডাক্তার বিভিন্ন ধরনের
সিদ্ধান্ত নেন।
এখন এমন হতে পারে যে ছবিগুলো
থেকে ডাক্তার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, কারণ হয়তো
ছবিতে আপনার সংক্রমণের কোন চিহ্ন তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু সেই আপনিই হয়তো বেশ
কিছুদিন বাদে যখন আবার সেই
একই পরীক্ষা করালেন তখন দেখা গেল পরিস্থিতি বেশ গম্ভীর। এর কারণ কি হতে পারে? আগের
বার আপনার পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়েনি তার কারণ কি সত্যি তখন কিছু ছিল না নাকি ছিল
কিন্তু তা এতই ক্ষুদ্র ছিল যে সেটা ঐ ধরণের ডাক্তারি পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রে ধরা
পড়েনি। যদি যন্ত্রগুলো আরেকটু বেশি কার্যক্ষমতা সম্পন্ন হত তাহলে হয়তো আপনার
চিন্তা একটু হলেও কম করা যেত।
এখন কার্যক্ষমতা বলতে আমি কি
বোঝাতে চাইছি সেটা একটু ব্যাখ্যা করি। আপনাকে যে রাসায়নিকটি খাওয়ানো হয়েছিল সেটি
আপনার শরীর থেকে একটি বিশেষ ধরণের আলোকরশ্মি (Photon) বের করতে
সাহায্য করে যেটা ডাক্তারি পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রগুলি সনাক্ত করে এবং ছবি তোলে।
ধরুন, সেকেন্ডে
আপনার দেহ থেকে ১০ টি Photon বের হচ্ছে। আর যন্ত্রগুলি ৫টি Photon সনাক্ত
করতে সক্ষম হচ্ছে। তাহলে যন্ত্রগুলির কার্যক্ষমতা হল (৫/১০)X১০০
শতাংশ = ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ কিনা শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে যন্ত্রগুলি নির্ভুল পরিমাপ
দেবে। আপনার দেহের ক্যান্সার/টিউমার-টির আকার যদি খুব ক্ষুদ্র হয়, তাহলে
স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে বেরোনো আলোর পরিমাণ (বা সংখ্যা) কম হবে এবং যন্ত্রগুলির
কার্যক্ষমতা অনুযায়ী সেগুলি সনাক্তকরণের সম্ভাবনা কমে যাবে।
দ্বিতীয় অংশে আমি যা বলতে চাই
তা একটু অর্থনৈতিক এবং একই সঙ্গে সামাজিক। যারা একটু খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন যে
এই ধরণের রোগগুলির চিকিৎসার যা খরচ তা আমাদের দেশের অনেক মানুষেরই নাগালের বাইরে।
এই রোগগুলির নিরাময়ে সাধারণ মানুষকে যে বিপুল অর্থব্যয় করতে হয় তার কারণ শুধুমাত্র
যে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির “রক্ষণাবেক্ষণ” খরচা
বা ডাক্তারদের বর্ধিত ‘পারিশ্রমিক’ তা নয়। এর
অন্যতম কারণ হল যে ধরণের যন্ত্রগুলিতে আপনার ছবি তোলা হচ্ছে তার অস্বাভাবিক মূল্য।
উদাহরনস্বরূপ ঐ যন্ত্রগুলিতে উপস্থিত এক বিশেষ ধরনের “crystal”-এর প্রতি
বর্গসেমির মূল্য খুব কম করেও ১০০ ডলার।
বেশ কিছুদিন থেকেই ভারতবর্ষসহ
পৃথিবীর বহুদেশের বৈজ্ঞানিকদের একটি বিশেষ অংশ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখাটির উপর
কাজ করে চলেছেন যাতে এই ধরণের রোগগুলির চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে দুটি প্রধান সমস্যার
কথা বললাম তার কোন সমাধান করা যায়। ভারতবর্ষে এই ধরনের কাজ করে এই রকম একটি দলের
সাথে আমার পরিচয় আছে। তারা মূলত একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করছেন
যেটা বর্তমানে ব্যবহৃত মূল্যবান যন্ত্রগুলির একটি পরিবর্ত হিসেবে কাজ করতে পারে।
দ্বিতীয় সমস্যাটির সমাধান করতে তারা অনেকটাই অগ্রসর হয়েছেন। তাদের দাবী যন্ত্রটি
যদি পরিপূর্ণরূপে বানানো যায় তাহলে চিকিৎসা খরচ অনেকটাই কমে যাবে। একটি তুলনামূলক
বিচারে তারা দেখিয়েছেন বর্তমানে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের প্রতি বর্গসেমিতে যেখানে দাম
পড়ে ১০০ ডলার সেখানে এই যন্ত্রটির প্রতি বর্গমিটারে খরচ পড়ছে ৭০০-৮০০ টাকা। প্রথম
সমস্যা অর্থাৎ যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা নিয়ে তারা বর্তমানে কাজ করছেন যাতে কিনা
যন্ত্রটি আরো নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারে। বর্তমানে তাদের যন্ত্র শতকরা ৩০ ভাগ
ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারবে বলে তাদের বিশ্বাস।
তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রের একটু
বর্ণনা দেওয়া যাক। যন্ত্রটি একটি ছোট বাক্সের মত দেখতে যার মধ্যে আছে Glass দিয়ে
তৈরি যন্ত্রাংশ। বাক্সটির মধ্যে থাকে একটি বিশেষ গ্যাস মিশ্রণ। বাক্সটিকে তড়িৎ
প্রয়োগ করলে যন্ত্রটি চালু হয় এবং তড়িৎ বন্ধ করে দিলে যন্ত্রটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
নিচের ছবিটি তাদের তৈরি যন্ত্রের একটি প্রতিরূপ।
বর্তমানে ব্যবহৃত দামী
যন্ত্রগুলি যে ধরণের ছবি তোলে সেটি সাধারণত ক্যামেরায় তোলা ছবির মত করে দেখতে হয়
অর্থাৎ কিনা ছবিটির শুধুমাত্র দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ থাকে। কিন্তু ভারতীয়
বৈজ্ঞানিকদের বিশ্বাস এই যন্ত্রটি ঠিকমত কাজ করলে এই যন্ত্রটি থেকে পাওয়া ছবির
একটি বেধও থাকবে। মানে আপনি যেভাবে খালি চোখে সাধারণ জিনিস দেখেন অনেকটা সেই রকমই
দেখতে পাবেন।
কিন্তু এই ধরণের বৈজ্ঞানিক
কাজের জন্য যে ধরণের পরিকাঠামো বিদেশে পাওয়া যায় তার অনেক কম নিয়েই তাদের কাজ করতে
হচ্ছে। তাদের মতে ভারতে এই ধরণের কাজে উৎসাহী মানুষের সংখ্যা কম বলেই এই ধরণের
বৈজ্ঞানিক কাজে পরিকাঠামো গড়ে উঠছে না। আশা করব ভারতবর্ষের মত দেশে বিভিন্ন
কর্মসংস্থানগত প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে তাদের প্রচেষ্টা যেন সফল হয় যাতে কিনা
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ধরনের মানবকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে উৎসাহী হয়।