Thursday, September 29, 2011

জীবন সৌরভ -- হিজিবিজবিজ

কিছুদিন আগে এই ব্লগে প্রকাশিত বিদায় পরিচিত লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। অতীতের ভালো লাগা ওই ছবিটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো। তখনই ভেবেছিলাম এরকম একটি লেখার কথা। তাই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো আমার ভালো লাগা অগুনতি ছবির একটি যা বারবার দেখার পরেও আজও আবার দেখতে ইচ্ছা করে।
এই ছবির মুখ্য চরিত্র দুইটি। প্রথমজন, চার্লি সিমন্স। মধ্যবিত্ত এক পরিবারের প্রতিভাশালী ছাত্র। সুঠাম, সুদর্শন, কর্তব্যপরায়ণ, আদর্শবাদী। এক কথায় ভালো ছেলে বলতে আমরা যা বুঝি। অন্যজন, রিটায়ার্ড লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফ্র্যাঙ্ক স্লেড। একসময়ের দাপুটে সেনানায়ক। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অন্ধ। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। দুনিয়ার প্রতি উন্নাসিক। উদ্ধত এবং মদ্যপ। এমনকি নিজের পরিবারের সাথেও তাঁর ব্যবহার এক কথায় অকথ্য। এমন একজন লোক, যাকে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই আপনি ঘৃণা করবেন। চার্লির সাথে ফ্র্যাঙ্কের পরিচয় নেহাতই বৈষয়িক কারণে। চার্লি Thanksgiving-এর ছুটিতে ফ্র্যাঙ্কের দেখাশোনা করার ভার নেয় Christmas-এ বাড়ি ফেরার প্লেনের টিকিটের টাকা উপার্জনের জন্য। এরই মাঝে চার্লির স্কুলে ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা এবং দুর্ভাগ্যবশত চার্লিকে হতে হয় তার সাক্ষী। অপরাধীদের নাম ফাঁস করার জন্য তাকে যথাযথ টোপ (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় recommendation) ও দেওয়া হয়। অন্যথায়
স্কুল থেকে বহিষ্কারের চরম শাস্তি। দ্বিধান্বিত চার্লি শাস্তির ভয় নিয়েও তার বন্ধুদের বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে। এই চূড়ান্ত মানসিক অস্থিরতার মধ্যেই চার্লির সাক্ষাৎ ফ্র্যাঙ্কের সাথে। হতাশাগ্রস্ত ফ্র্যাঙ্কের জীবনের কাছ থেকে পাওয়ার কিছু নেই। তিনি আত্মহত্যার সংকল্প করেন। তবে তার আগে তাঁর ইচ্ছা জীবনের শেষ দুটি দিন নিজের মত করে বাঁচার। নিজের দুনিয়ায়, রাজার মতো। ঠিক এখানেই এহেন দুর্বিনীত ফ্র্যাঙ্কের প্রতিও আপনার সহানুভূতি জেগে উঠবে। সত্যিই তো! একটা মানুষ, সে যেমনই হোক, নিজের ভালো লাগামন্দ লাগা নিয়ে বাঁচার অধিকার তো তারও আছে! ফ্র্যাঙ্ক, যুদ্ধের ময়দানে দেশের গরিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে নিজের জীবন বাজি রেখেছেন তিনি। আর আজ ভাগ্যের পরিহাসে জীবনযাপনের জন্য পরনির্ভরশীল। সেই কারণে হয়তো কিছুটা অভিমানীও। কিন্তু কারও সহানুভূতি নিয়ে তিনি বাঁচতে চান না। চার্লি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে ফ্র্যাঙ্ককে। অসমবয়সী দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে থাকে। চার্লি জানতে পারে ফ্র্যাঙ্কের প্রথম পছন্দ সুন্দরী কোনও নারীর সাহচর্য, যা আন্তরিকভাবে তিনি কোনদিনই পাননি আর তার পরের কিন্তু অত্যন্ত দূরের দ্বিতীয় পছন্দ ফেরারি গাড়ি। চার্লিকে নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক নিউ ইয়র্ক এ আসেন তাঁর জীবনের শেষ দিনটি উদযাপন’ –এর জন্য।


সব কিছু তাঁর পরিকল্পনা-মাফিক এগোলেও পরের দিন আত্মহত্যা করতে গিয়ে তিনি বাধা পান চার্লির কাছে। ভোলা যায় না, ফ্র্যাঙ্কের ক্লান্ত আর্তনাদ…. “give me one reason to live”উত্তরে চার্লি জানায়, ফ্র্যাঙ্কের মত ট্যাঙ্গো নাচতে আর ফেরারি চালাতে সে আর কাউকে দেখে নি। কি মনে হচ্ছে ? উত্তরে তো ক্রুদ্ধ ফ্র্যাঙ্কের গর্জে ওঠার কথা.... কতখানি দুনিয়া তুমি দেখেছ হে ছোকরা”? কিন্তু না। চার্লির কথা শুনে ফ্র্যাঙ্কের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে প্রশান্তি। হ্যাঁ, তিনি এখনও পারেন। এখনও পারেন কাউকে কাউকে মুগ্ধ করতে! ঐ চোখদুটো ছাড়াই। নেহাতই ছেঁদো কারণ মনে হচ্ছে কি বেঁচে থাকার জন্য? না। কোন কারণেই কারও জীবনধারণ করাটা অর্থহীন নয়। মরতে কি আমরা কেউই চাই? তাহলে মানুষ সব হারিয়েও কেন ভিক্ষাবৃত্তি করেও জীবনধারণ করতে চায়? চরম হতাশা, চরম অবসাদের মুহূর্তেও আমরা আশার আলো খুঁজি, বাঁচার কারণ খুঁজি। তখন শুধু দরকার কোন বন্ধুর সঙ্গ। বা কোন প্রিয়জনের। যার কাছে আপনার নগণ্য অস্তিত্বটাও ‘special’ না-ই বা চিনল দুনিয়া আপনাকে.... একজন-দুজনের চাওয়াটাই কি কম পাওয়া? ঐ ফ্র্যাঙ্কের মত ট্যাঙ্গো নাচার জন্যই কেউ হয়তো জীবনের বাকী সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্ক আবার বাঁচার অঙ্গীকার নেয়। পরের দিন ফেরার পথে চার্লিকে স্কুলে ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। অন্ধ ফ্র্যাঙ্ক চার্লির মুখের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে তার চেহারা কল্পনা করার চেষ্টা করেন। নাকি দৃঢ়চেতা এই তরতাজা তরুণটিকে দিয়ে অনুভব করতে চান জীবনের রূপ-রস-গন্ধ ? তাঁর ভয় ছিল, এই ক্ষমাহীন দুনিয়া চার্লির ভিতরের নিষ্পাপ মানবিক সত্ত্বাটিকে এক লহমায় খুন করতে পারে। তাঁর ভয় ছিল, চাপে পড়ে চার্লিকে হয়তো যেতে হবে সমঝোতার সুবিধাবাদী রাস্তায়, যা আমরা প্রায় সকলেই করে থাকি আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য। অথবা মাথা পেতে নিতে হবে কঠিন শাস্তি। পরিণাম? ব্যর্থতা .... পেয়েও না পাওয়া সচ্ছল জীবনের হাতছানি, যা চার্লির মত এক প্রাণবন্ত তরুণকেও ঠেলে দিতে পারে অবসাদের গহীন অন্ধকারে। কি করবেন ফ্র্যাঙ্ক? তিনি কি এখনও সত্যিই পারেন পার্থক্য গড়ে দিতে ? না, আর বলব না। আর সত্যি কথা বলতে, শেষের এই অংশটুকুর সংলাপ এবং অভিনয় ভাষায় প্রকাশ করি এমন কলমের জোর আমার নেই। ছবির শেষে ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। বাড়ি ঢোকার মুখেই আঙ্গিনায় নিজের যমজ নাতি-নাতনির সাথে অর্থহীন খেলায় মেতে ওঠেন ফ্রাঙ্ক। বৃদ্ধ ফ্র্যাঙ্ক আবার ফিরে এসেছেন জীবনের কাছেই।


ছবিটিতে কোন আড়ম্বর নেই। হলিউডি থ্রিলারের চোখ ধাঁধানো গতি নেই। ঘন ঘন দৃশ্য পরিবর্তন নেই। ক্যামেরার কারসাজি নেই। আছে সাদামাঠা পরিবেশনা, একটি অসাধারণ স্ক্রিপ্ট আর ফ্র্যাঙ্কের ভূমিকায় Al Pacinoর অসাধারণ অভিনয়। অভিনেতাদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে মুখের ভাষার মত চোখের ভাষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিন্তু Al Pacino সে সুবিধা পান নি। ফ্র্যাঙ্কের চোখ পুরো ছবিতেই পাথরের মত স্থির। তা সত্ত্বেও তাঁর মুখে বিভিন্ন সময় রাগ, ঘৃণা, অভিমান, অসহায়তার যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা এক কথায় অনবদ্য। চার্লির ভূমিকায় Chris O’Donnell ও সাবলীল। ও, এতক্ষণ তো ছবির নামটাই বলা হয় নি। ছবির নাম Scent of a Woman”, নির্দেশক Martin Brestউৎসাহী পাঠকদের জন্য জানিয়ে রাখি, এই ছবিটি আসলে একটি ইতালিয়ান ছবি Profumo di donna”-র রিমেক। ছবির চিত্রনাট্য লেখা Giovani Arpino রচিত একটি ইতালিয়ান উপন্যাস থেকে, নাম, “Il buio e il miele” (Darkness and Honey)এই ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসাবে Al Pacino কে অস্কার দেওয়া হয় সেরা অভিনেতা বিভাগে। ছবিটি না দেখে থাকলে পাঠকদের কাছে আবেদন, সময় পেলে একটু কষ্ট করে জোগাড় করে ছবিটা দেখে ফেলুন। ঠকবেন না। আর দেখে কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। যেসব পাঠক ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছেনভালো লাগবে যদি আপনারাও আপনাদের অভিজ্ঞতা এখানে share করেন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই