Sunday, September 25, 2011

পুজোর ইতিকথা -- মৈনাক


শীত শেষ হতেই বসন্ত আর বর্ষা শেষ হতেই শরৎ, আর শরৎ কাল মানেই পুজো। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, কাশ ফুল... আমাদের চোখে এটাই শরৎ কাল। যদিও
এবার বর্ষা যেন শেষ হতে চাইছে না, তবে পুজোর আগে আগে বর্ষা চলে যাওয়াটাই কাম্য, না হলে পুজোয় ভোগান্তি। আমাদের জীবনে যত দুঃখ কষ্টই থাক পুজোতে আমরা আবেগে আনন্দে ডগমগ থাকি। শহর বা শহরতলিতে আমরা যারা বাস করি তাদের আনন্দ আহ্লাদের সীমা থাকে না। পুজো মানে শুধুই খুশি, আনন্দ, আড্ডা, ঘোরা, অঞ্জলি দেওয়া আরও কতো কী।
শৈশব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত পুজোই না অতিক্রান্ত হয়েছে। কত স্মৃতি বাসা
বেধেছে এই মন জুড়ে। মার হাত ধরে কত ছোটবেলায় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। এখানে অবশ্য বলা প্রয়োজন আমি দক্ষিণ কোলকাতার যাদবপুরসংলগ্ন এলাকায় ছোটো থেকে বড় হয়ে উঠেছি। আমি ঠিক যে সময়টার কথা বলছি, তখন থিম পুজোর চল সে ভাবে চালু হয়নি। এখন যে ভাবে পুজো মণ্ডপ গুলিতে পঞ্চমী থেকেই ভিড় উপচে পড়ে তা তখন দেখা যেত না, বেশ কিছু নামী বারোয়ারি পুজোয় ভিড় হত ঠিকই তবে সেটা সপ্তমী বা অষ্টমীর রাতে। আসলে পুজো এসে গেলে তো আনন্দ-ফানন্দ সব মাটি। তার কারণ কতক্ষণে ঠাকুর দেখা সারতে হবে, কোনদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে হবে, কোনদিন শুধু বান্ধবীর জন্যই সময় দেওয়া... এত কিছু করতে করতে পুজোই তো শেষ, তার চেয়ে যতক্ষণ পুজো না আসছে ততক্ষণ মজা।
 আমি যখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি তখন আমাদের পাড়ায়, আমাদের আত্মীয় বলা যেতে পারে, সেই আত্মীয়ের বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়েছিল। সেবার তাদের বাড়ির পুজোয় খুব আনন্দ করে কাটিয়েছিলাম। মনে পড়ে এখনো, পঞ্চমী থেকে দশমী- খাওয়া ঘুমানোটাও ওদের বাড়িতে ছিল, সেই পরিবারের একটি ছেলে আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমার সেই বন্ধুর বাড়িতে বছর পনেরো যাবৎ কোনো পুজো হয়নি। না, সেটা শুনে পাঠকগণের চমকে ওঠার কোনো কারণ নেই, ওটা ওদের পারিবারিক কারণ। আমার কাছে দুঃখ সেটায় নয়, ওরকম বাড়ির পুজোতে আনন্দ করে কাটানো খুব কমই হয় জীবনে।
আমার জীবনে আরো একবার এরকম সুযোগ এসেছে, তবে সে যাত্রায় একটু বাধা এসেছিল। ঠিক যেমন হাজার কাজের ফাঁকে একটু অবসর আসলেও কাজের কথাটাই বারেবারে মনে হয় ঠিক তেমনটাই হয়েছিল সেবার। আমি তখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি তাই ছুটিও কম। পুজোর ওই চারদিনই হাতে সময় তার মধ্যে আবার বৃষ্টি। সেবারও এক বন্ধুর বাড়িতে পুজোর ছুটি কাটিয়েছিলাম, তবে কোলকাতায় নয় একটু দুরে, এই বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব কোলকাতায়।
একটা গ্রাম তার মাঝে ছোট ছোট কয়েকটা ঘর, ঘরগুলো ছাড়িয়ে দূরে একটি পুরোনো আমলের জমিদার বাড়ি। বহু প্রাচীন বহু ইতিহাস বহন করে চলেছে ওই বাড়ি এবং কয়েক পুরুষ ধরে বিভিন্ন শরিকরা মিলে দুর্গা পুজো করছে। আমাদের উত্তর কলকাতায় শোভাবাজারের রাজবাড়ির দুর্গা পুজোর তুলনায় এই বাড়ির পুজোও কিছু কম নয়। দুর্গা পুজোর মণ্ডপ, একচালা ঠাকুর, পঞ্চপ্রদীপ,সন্ধ্যারতি... অষ্টমী পুজো দেখবার মতো- তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী অবধি কাটিয়ে নবমীর দিন সকালবেলায় রওনা দিলাম কোলকাতায়, সেদিন বৃষ্টিও ছিল বেশ, রাত আটটায় পৌঁছলাম বাড়িতে। সেবারের মত পুজো শেষ হল কোলকাতার বাইরে। স্মৃতিতে শুধু রয়ে গেল সেসব লোকগুলির মুখ যাদের সাথে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সাক্ষাৎ হয়েছিল, কিন্তু সেভাবে পরিচয় হয়ে ওঠেনি। যারা প্রতিমার চালা সাজানো থেকে শুরু করে মণ্ডপ সাজানোর কাজে নিযুক্ত ছিল, যাদের তোলা পদ্মফুলে মায়ের পুজো হয়, যে ঢাকির বাজনায় রোজ পুজো শুরু ও শেষ হয় সেইসব মানুষগুলি সারাবছর কোথায় থাকে? কী বা তাদের জীবিকা ---এই প্রশ্নগুলো এখনো আমায় তাড়া করে।
পুজোর সময় কোলকাতা ছেড়ে কলকাতাবাসীদের কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, মানে কোলকাতা ছেড়ে নট নড়ন চড়ন। তবু বলছি যান না অচেনা অজানা কোনও গণ্ড গ্রামে, আমি সত্যি বলছি আপনার পুজোটা মন্দ যাবে না। তবে হ্যাঁ এইটুকু শুধু খোঁজখবর নিন  যে সেখানে কোনো বাড়িতে দুর্গা পুজোর চল আছে কিনা? যদি বা নাও থাকে তাহলে খোলা আকাশ আছে, আছে কাশবন, পাখিদের ডাক, কোনো ঝিল বা পুকুরে ভেসে থাকবে শাপলা, পদ্ম আর দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসবে ঢাকের শব্দ। আর খাওয়া দাওয়া তাও হয়ে যাবে আদর্শ হিন্দু হোটেলের মত কোন জায়গায়। যান না, একবার একটু দেখুন সেসব মানুষগুলোকে। যারা জল থেকে পদ্ম ফুল তুলে কলকাতার বাজারে পাঠায়, যারা পুজার ভোগের জন্য ফল আনাজ তোলে তাদের কাছে যান, দেখবেন তারা কিভাবে আছে। খুব serious হয়ে গেলাম দাদা! আচ্ছা পুজোতে কী এদের সাথে আনন্দ করে কাটানো যায় না?
আনন্দ খুশি তো শুধু আপনার একার সম্পত্তি নয় যে একা একা করবেন , যখন পুজোতে আনন্দ উপভোগ করার সবার অধিকার আছে তবে কেন শুধু নিজের জন্য নতুন জামা কাপড়? আর যে ছেলেটা বাজারে ফল সব্জি বিক্রি করে তার কি কোন আনন্দ ইচ্ছে থাকতে নেই না নতুন কাপড় জামা পড়ার অধিকার নেই? আপনি বাবুটি হয়ে যাবেন বাজারে আর বলবেন কিরে শশা কত করে যাচ্ছে রে ?’ বাঃ! এভাবে আর কতদিন? নিজের সাথে আরো পাঁচ জনের কথাও একটু ভাবুন।
রোজ কত আড্ডা, কত তর্ক, বিতর্ক, খেলা-নাটক-গান-ফুটবল মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল, মেসি জ্বরে আক্রান্ত সারা শহর। তারপর পুজো আসলে তো কোন কথাই নেই পঞ্চমীতে সুরুচি সংঘ, ষষ্ঠীতে লেকটাউন, সপ্তমীতে বাবুবাগান একডালিয়া নামি পুজো মণ্ডপ বলে কথা একবার হলেও তো যেতে হবে, না হলে তো জীবন বৃথা। আর নবমীতে কোন পাড়ার মণ্ডপে বসে আড্ডা, দশমীর সকাল থেকে শুভ বিজয়ার আগাম sms এ শুভেচ্ছা বিতরণ।
প্রতি উৎসবে এই রকম ভাবে সামিল হওয়াই কি আমাদের রীতি ? যদি এটাই রীতি হয় তা বদলানোর দায়িত্ব আপনার এবং আমার। একবারের জন্য একটু ভাবুন সেই ছেলেটার কথা, যে প্রতিদিন আপনার বাড়িতে পেপার ছুঁড়ে দেয়, যে ছেলেটা রোজ আপনার অফিসের টেবিলে চা-টা দিয়ে যায়, যে মেয়েটা রোজ আপনার বাড়িতে জল তোলা থেকে বাসন মাজা সব করে- তাদের পুজোটা কেমন কাটে, কেমন হয় তাদের পুজোর আনন্দ, একবার পারলে তাদের সাথে যান না তাদের গাঁয়ে। দেখবেন তাদের আদর আপ্যায়ন আমার আপনার থেকে ঢের গুণ বেশি। পুজোর আর বেশি বাকি নেই তাই সবাই মিলে শুরু করি এক নতুন উৎসবের সূচনা, যেখানে সবাই এক, নেই কোনো জাতি ভেদাভেদ। শুধুমাত্র হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই এই সম্প্রীতির জিগীর না তুলে নিজের জাতি ধর্ম বর্ণের প্রতি আমাদের সকলের যে কর্তব্য সেটা পালন করার চেষ্টা করি।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই