"উফ্ ! একেবারে ঘাড়ের উপর উঠে
পড়ছে...অসহ্য !!
দেখতো এবার...এটা মানাচ্ছে?
নারে...আগের মেরুন টাই better...
কি, কথা কানে যাচ্ছে না? শ্বশুরের দোকান পেয়েছে.." [ স্থান- গড়িয়াহাট বাজার]
“ যা না...বাবার কাছে যা...
বাবা তো তোমার কাছে থাকতে বোল্লো..
একটা জিনিস একটু দেখবো তার জো নেই...” [ স্থান-
হাতিবাগানের ফুট]
“জানিস নিলো না কিছুতেই...
এমা!! তাহলে শাড়ীগুলো পরবি কিভাবে?
জানিনা কি করব...দেড় মাস আগে থেকে অর্ডার নেওয়া
বন্ধ করে দেবে কি করে জানব বলত!!
বলিস কি ! আর নেবে না?” [স্থান- চলন্ত
বাস]
হ্যাঁ , ঠিকই ধরেছেন। ওপরের টুকরো টুকরো কথাবার্তা
গুলো পুজোর বাজার নিয়েই। খেলা বোল্লে যেমন ফুটবল, ফুল বোল্লে
যেমন গোলাপ তেমনি উৎসব বোল্লেই পুজো। আর বাঙ্গালির কাছে সেটা দুর্গা পুজো। মাত্র
পাঁচ দিনের এই পুজোকে ঘিরে উন্মাদনার পারদ কিন্তু চড়তে শুরু করে প্রায় দুমাস আগে
থেকেই। যে জ্বরের কাঁপুনিতে এই পারদের উত্তরণ তা হল -"পুজোর বাজার"।
আসলে আমরা , আমরা বাঙ্গালিরা বিশেষ করে, কিছু একটাতে মেতে থাকতে ভালোবাসি। এই মত্ততাটা আমাদের মজ্জাগত। মাত্র পাঁচ
দিনের পুজোয় আমাদের এই মত্ত-মন কিছুতেই যেন ভরতে চায়না। তাই মনের রসদ জোগানোর জন্য
ওই কটা দিনের নানান রকম প্ল্যানের জল্পনা কল্পনা করতে শুরু করি আমরা অনেক আগে
থেকেই। অষ্টমীর সকালে স্নান করে নতুন পাঞ্জাবী বা করমরে শাড়ীর ভাঁজ ভাঙ্গা,বা নবমীর সন্ধ্যেয় নতুন জিন্সের ট্যাগ কাটা, সবচেয়ে
পছন্দের শাড়ীটাকে গায়ে তোলা, পরার আগে একবার নতুন গন্ধটা
শুঁকে নেওয়া ...সে এক 'ডিভাইন' অনুভূতি।
স্মৃতির পথ ধরে একটু পেছনে ফিরে গেলে ভেসে ওঠে সেই জামা-প্যান্টের হিসেব নিকেশ
গুলো। এই! তোর এবার কটা হলো রে? তিনটে জামা দুটো
প্যান্ট...তোর কটা? আমার চারটে চুড়িদার দুটো
স্কার্ট...ইসসস!! 'হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল'.........
যাক, যে কথা হচ্ছিলো...এই প্ল্যান-পর্বের
সিংহভাগ জুড়ে থাকে সাজ-পোশাক। কবে কোনটা পরব, তার সঙ্গে কি
কি গয়না পরব, কি ধরণের ব্যাগ, কোন
জুতোটা ঠিকঠাক যাবে তার সঙ্গে, দিনের বেলা হলে কোন
সানগ্লাসটা নেব (মুখের চাইতে বড় হলেও সেটাই পরতে হবে...trend বলে কথা!!),সরু ঘড়ি না মোটা ঘড়ি কোনটা মানাবে (আজকাল
দেওয়াল ঘড়িও হাতে পরছে দেখছি !!)...এসবই এই প্ল্যানের component । এটা যেন পুজোর কদিন
আমাদের নিজেদের সেরা performance
দেওয়ার একটা প্রস্তুতিপর্ব। এই প্রস্তুতি শুরু হয় পুজোর বাজারের
মধ্যে দিয়ে।
কালের নিয়মে অনেক কিছুই পাল্টেছে। মণ্ডপের সাজসজ্জা
( যাকে 'পুজোর থিম' বলা হচ্ছে) থেকে শুরু করে আমাদের
সাজসজ্জা। হলফ করে বলতে পারি ফ্যাশন জগতের এই বিপুল বৈচিত্র্য আজ থেকে বছর কুড়ি
আগেও এতটা ছিলনা। ফ্যাশনের মেটামরফোসিস অনেকটাই হয়েছে বিশ্বায়নের হাত ধরে।
বিশ্বায়ন-পূর্ব বাঙ্গালির ফ্যাশন নিয়ন্ত্রণ করেছে সিনেমা, মূলত
বলিউডের সিনেমা। ষাট সত্তরের দশক বাঙ্গালির ফ্যাশন বাজার দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই
বলিউডের নায়ক নায়িকারা। 60s এর drainpipes
pant,70s এর bell-bottom
থেকে শুরু করে আশা পারেখদের অসম্ভব চাপা (confused হয়ে যাই, পরার পর সেলাই করা নাকি সেলাই করে পরা!!)
সালোয়ার কামিজ বা শর্মিলাদের নিখুঁত প্লিটেড শাড়ী রা মাথার চাইতে বড় খোঁপা রাজ করে
বেড়িয়েছে বাঙ্গালির ফ্যাশন দুনিয়ায়। আশির দশকের শেষ থেকে টেলিভিশনের বিভিন্ন
চ্যানেলের দৌলতে ,পত্রপত্রিকা গুলোর ফ্যাশন চর্চার কল্যাণে (?)
সাজসজ্জায় একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। নায়ক নায়িকাদের সঙ্গে
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের ঘরের আলনায় এসে গেছে শক্তিমান , স্পাইডারম্যান
বা ব্যাটম্যানদের মতো সব সুপার (ডুপার) হিরোরা। বিশ্বায়ন পরবর্তী বাঙ্গালির
ফ্যাশনে আবার লেগেছে আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া। সিনেমা সিরিয়াল দ্বারা ক্রমাগত
নিয়ন্ত্রিত বাঙ্গালির আলমারিতে তাই এসেছে নানা স্বাদের জামাকাপড় । গ্রহণ
পুনর্গ্রহণের মধ্যে দিয়ে কখনো উঠে
এসেছে চোস্ত জিন্সের মতো মেট্রো স্টাইল, কখনো বা ফিরে
গেছে বেল-বটসের মতো রেট্রো স্টাইলে। শুধু কাপড়জামা নয়। ছোট্টবেলার সেই লেস দেওয়া
বুট জুতো বা power এর স্পোর্টস স্যু তে যে হাঁটা শুরু হয়েছিল
আজ তা এসে ঠেকেছে cowboy shoes এ। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির একটা
বড় অংশ রিতু বেরি বা সব্যসাচীর ডিজাইন সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল না হলেও অনেকেই
দোকানে গিয়ে "তারকা"দের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদেরকে এক লহমায় বান্টি আর
বাবলি ভেবে ফেলে। পুজোর ওই কটা দিনে সে একই সঙ্গে হতে চায় সাবেকিয়ানায় ভরপুর পরিণীতার
বিদ্যা বালান বা সরকার রাজ এর কর্পোরেট লুকস 'র ঐশ্বর্য্য।
কিন্তু আজকাল একটা জিনিস বেশ ভাবাচ্ছে। বাঙ্গালির
এই "ট্রেন্ড-সর্বস্ব ফ্যাশন" থেকে ক্রমেই "স্টাইল " ব্যাপারটা
সরে যাচ্ছে। যার ফলে ফ্যাশনে একটা uniformity চলে আসছে। যেটা বড্ড একঘেয়ে। এসব
ভারী ভারী কথা আজ এখানে থাক। সে নিয়ে পরে কথা বলব আপনাদের সঙ্গে। পুজোর আবহাওয়ায়
তা খুব বেমানান।
জামাকাপড়ের স্বাদ পাল্টেছে। স্টাইল পাল্টেছে।
ফ্যাশন পাল্টেছে। পাল্টায় নি শুধু পুজোর বাজারের প্রতি বাঙ্গালির আবেগ। তাই একটু
ছড়া কাটার চেষ্টা করি----
পুজো মানেই শরৎ আকাশ
কাশফুল আর ঢাক
পুজোর সাজে সবার মাঝে
জমিয়ে কদিন যাক...
সবাইকে আগাম শারদীয়ার শুভেচ্ছা...