ছবির উৎস: লিঙ্ক |
যে কথাগুলো লিখতে চলেছি, আমি জানি তার
জন্যে আমার জেল হবে না। ফাঁসি তো
দূরস্থান। সেটা এই জন্য নয় যে ভারত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এখানে বাক্-স্বাধীনতা আমার মৌলিক অধিকার। আমি নির্ভয়ে কথাগুলো বলতে চলেছি এই জেনে যে এই কটি প্রলাপে কারও কিচ্ছু আসবে যাবে না। সব যেমন চলছিল তেমনি চলবে। আমি তার আগে বলে নিতে চাই যে আমি এই দেশ ও তার অখণ্ডতার
দূরস্থান। সেটা এই জন্য নয় যে ভারত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এখানে বাক্-স্বাধীনতা আমার মৌলিক অধিকার। আমি নির্ভয়ে কথাগুলো বলতে চলেছি এই জেনে যে এই কটি প্রলাপে কারও কিচ্ছু আসবে যাবে না। সব যেমন চলছিল তেমনি চলবে। আমি তার আগে বলে নিতে চাই যে আমি এই দেশ ও তার অখণ্ডতার
তবে দেশ বলতে আমি কাঁটাতারে সুরক্ষিত
পাহাড়-জঙ্গল-মরু-সমুদ্রের সমষ্টি বুঝি না, দেশের প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ
হল দেশের মানুষ। যারা একসঙ্গে থাকতে চেয়েই অনেকের মতো সাতচল্লিশের সন্ধ্যায় পালিয়ে
আসেনি বা চলে যায়নি। কিন্তু যারা পালিয়ে আসা বা চলে যাওয়া কোনটাই করতে চায়নি?
মানে সুদূর উত্তরে বরফঢাকা সেই ভারতীয় রাজ্যটির মানুষেরা? কাশ্মীর, আমার আপনার সাধের ভূস্বর্গ। প্রতিবেশীর
প্ররোচনায় যারা নাকি আজ দিল্লি-বিমুখ। আচ্ছা, দিল্লি-সুমুখ
তারা কি কোনদিনও ছিল? হিন্দু রাজার কলমের খোঁচায় একটি
সিদ্ধান্ত যাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, কেমন আছেন তারা?
ইতিহাস বলছে প্রায় একবছর মহারাজ হরি সিংহ এপার ওপার কোনদিকেই যোগ
দেননি। চিরনাবালক আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি যখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধেয়ে এলো,
হরি সিংহ উপায়ন্তর না দেখে যোগ দিলেন (স্বাভাবিকভাবেই) হিন্দুপ্রধান
রাষ্ট্রটির সাথে। তাঁর সিংহাসন ও রাজদণ্ড ভারতের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুসারেই ক্ষমতা
হারালো। কিন্তু গণতন্ত্রের সূচনালগ্নেই দেশের সঙ্গে যোগ দেওয়া একটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে
এলো অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের অভিযোগ। সেই অভিযোগ তারা করে চলে আজও। সেখানকার আদি
বাসিন্দাদের মধ্যে বিখ্যাত কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা অচিরেই পূর্বতন পড়শি ও চেনাশুনো
লোকজনের দ্বারা বিশ্রীভাবে লাঞ্ছিত, আহত এমনকী নিহত হয়ে
আশ্রয় নিলেন রাজধানীর শরণার্থী শিবিরে। বিনিময়ে খাকি ও কালো উর্দি সশস্ত্র এবং
ক্ষেত্রবিশেষে নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের যমের বাড়ি থুড়ি জাহান্নমে পাঠালেন। এতে না
বাড়ল আমাদের কিছুমাত্র মর্যাদা, না ঘটল তাদের দাবি পূরণ। সেই
দিনটি থেকে আজ পর্যন্ত শ্রীনগরকে নিয়ে বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা খেলে চলেছে সকলে।
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
প্রথম রাউণ্ডে, ভারতের প্রাচীনতম এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সমস্যার সামরিক সমাধান করতে চাইলেন, দিলেন সেনা পাঠিয়ে। বাদ
সাধলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নাকি ততদিনে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আশা
জেগেছে। যাক, সেগুড়ে বালি। টুপি মাথায় নোবেলতলা আর তাঁর
যাওয়া হয়নি। অনেকেই মনে করেন যে, আজ যেভাবে ধর্মীয়
উগ্রপন্থার সশস্ত্র সমাধান পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে, খলিস্থানি
জঙ্গিদেরকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়া গেছে, সেদিন
সেভাবেই কাশ্মীরকেও ‘ঠাণ্ডা’ করে দিতে
পারত নয়াদিল্লি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অদূরদর্শী প্রধানমন্ত্রীর
কারণে সেটা নাকি সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয় রাউণ্ড, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় প্রজাশাসনের চারটি
ধারার উল্লেখ আছে- সাম, দান, ভেদ,
দণ্ড। মানে, বেয়াড়া প্রজাকে প্রথমে বিশাল বার
খাওয়াও, তাতে কাজ না হলে অল্প কিছু টাকাকড়ি দাও, তাতেও কাজ না হলে তাদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা কর, সবশেষে
দরকার হলে পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখাও। ওই যে পাঞ্জাবের কথাটা বললাম, শুধু রাইফেল দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করা যায়নি, সবুজ
বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলাফল আজকের শান্ত পাঞ্জাব। প্রথমেই লাঠি ধরার পর তাতে যখন কাজ
হল না, তখন দিল্লি অকারণ তোষণের পথে হাঁটল। প্রতি বছর দেশের
আর্থিক বাজেটে অবশিষ্ট দেশবাসীর করের টাকায় নানা ধরণের ভর্তুকি দেওয়া হল
কাশ্মীরকে। তেনাদের আবদার মেনে অন্যান্য ভারতীয়দের অধিকার ওই রাজ্যটিতে সঙ্কুচিত
করা হল। আমি-আপনি চাইলেই কাশ্মীরে পাকাপাকি বসবাস করতে পারি না, স্থায়ী সম্পত্তি কিনতে পারি না, সংবিধান তার কুখ্যাত
৩৭০ ধারায় আপনাকে বকে দেবে (অবিশ্বাসীদের জন্য: http://en.wikipedia.org/wiki/Article_370)। এছাড়া ভূস্বর্গ-কেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা খাতে আর্থিক বাজেটের
প্রায় ৩৬ শতাংশ খরচ করতে থাকল দিল্লি। হা হতোস্মি! দেখা যাচ্ছে, তাতেও কাজ হয়নি,
নিয়মিত ইতিউতি বিস্ফোরণে সেটা মালুম পড়ছে বেশ।
তৃতীয় রাউণ্ডে মাঠে নামল গেরুয়া-বিলাসী দেশভক্তরা।
গত প্রজাতন্ত্র দিবসে কাশ্মীরে গণ-পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী নিল তারা। বাহ্ বাহ্, বেশ বেশ। কিন্তু
হঠাৎ এই দেশভক্তি? তারা এর আগে অযোধ্যার উনুনে রুটি সেঁকে
দেখেছে, সেটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনই
পুষ্টিকর। অতএব গোটা দেশে, বিশেষত কাশ্মীরে এমন কয়েকটা
তন্দুর তৈরি করে ফেলতে পারলে তাদের আর অন্নকষ্ট থাকে না। তাই একটা নতুন অশান্তি
বাঁধানোর উদ্দেশ্যেই তাদের এই Mission Kashmir। যাহোক, কেন্দ্র-সরকার
নিজের মুখ পুড়িয়ে সে যাত্রা কোনক্রমে শ্যাম ও কুল- দুইই রাখল। কদিন রাখা যাবে,
কে জানে!
রাউণ্ড চার: সাহারা মরুভূমির ঠিক ওই পাশের দেশটি
বরাবরই কাশ্মীর নিয়ে খুবই আগ্রহী। এইটি ছাড়াও দেশে বিদেশে ধর্মযোদ্ধা চালান করার
ব্যাপারে তাদের সুনাম বিশ্বজোড়া। শুরুর দিনটি থেকে আজ অবধি প্ররোচনা, প্রশিক্ষণ এবং
সামরিক সহায়তার মাধ্যমে ভূস্বর্গের আঞ্চলিক অস্থিরতা বজায় রেখেছে তারা। নিজের ঘরে
না আছে পেটের ভাত, না শীতের কম্বল। কাজেই সেখানকার
রাজনেতাদের পক্ষে নির্বাচন (যদি আদৌ কয়েক যুগে এক-আধবার হয়, জন্মলগ্ন
থেকে আজ অবধি তারা বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে সেনা ছাউনির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ
শাসনে!!) বৈতরণী পার হওয়ার একমাত্র রাস্তা- অন্ধ ভারত-বিদ্বেষের প্রচার। খুব
সম্ভবতঃ তাদের নেতারা কোনদিনই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চান না। ওই যে বলে না,
সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে......
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
পঞ্চম রাউণ্ড: এই রাউণ্ডে নিখুঁত পারফরম্যান্স
হোয়াইট হাউস আর তার লণ্ডননিবাসী মোসাহেবের। তারা মাঝে মাঝেই ভারত-পাকিস্তান বিহারে
আসেন। দিল্লিতে এসে কাশ্মীরের ওপর ভারতের অধিকারকে সিলমোহর দেন, ইসলামাবাদে গিয়ে
যস্মিন দেশে যদাচারঃ। তারপর নিজের ঘরে ফিরে দুজনকেই পার্সেল করে পাঠিয়ে দেন আধুনিক
মারণাস্ত্র, লাভের কড়িতে ঘর ভরে ওঠে তাদের। শোনা যায়,
আজকাল নাকি হোয়াইট হাউসের সব মালিকই এই বিষয়ে একটু নাক গলাতে চান,
সোনার নোবেল মেডেলের হাতছানিতে।
ছবির উৎস: লিঙ্ক |
না, মোটে পাঁচটি রাউণ্ডে এই খেলা শেষ হবার নয়,
মাঝে মাঝে নিজেরই প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, তাহলে এত দিন ধরে এত ভারতীয় সেনা যে শহিদ হল সেই ভূখণ্ড এমনি এমনি ছেড়ে
দেব? না, তাদের জীবনদান বৃথা যায়নি,
অন্তত সিংহভাগ কাশ্মীর এখনো পাকিস্তানের করায়ত্ত নয় তাদেরই
কৃতিত্বে। কিন্তু আর কেন? এই খেলায় শুরুর রাউণ্ড থেকে কেউ
জেতেনি, প্রথম থেকেই হেরে চলেছে একদল, কাশ্মীরিরা।
আমরা কি পারিনা, নিজেদের তত্ত্বাবধানে ওখানে গণভোট জাতীয় কোন
মতামত গ্রহণ করতে? আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি
একই সঙ্গে POK, মানে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কথাও বলছি। মনে
রাখবেন, নিকট অতীতে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্বতিমোর বিচ্ছিন্ন
হয়ে যায় এই জাতীয় একটি গণভোটের পর। সেটি হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে।
তারপর অবশ্য ওই দুই দেশ বেশ শান্তিতেই আছে। আমার বক্তব্যের ভুল অর্থ করাটা খুবই
সহজ, তাই আর একবার বলতে চাই, কাশ্মীরকে
পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার চাইতে ওখানে গণতান্ত্রিক বা সামরিক ভারতীয় শাসন চলা
অনেক ভালো। কিন্তু আরো ভালো কাশ্মীরের নিজস্ব মতামতকে সম্মান দেওয়া গেলে, যদি তারা সত্যিই আলাদা থাকতে চায়, দু’জনের কারোর সাথেই না গিয়ে স্বাধীন থাকতে চায়, তাহলে
ওই নিয়ে অর্থ, বল, সামাজিক স্থিরতা
নষ্ট করে অবশিষ্ট ভারতকে কষ্ট দেওয়া আর কেন?