একটি হাউসিং এস্টেটের
ক্যাম্পাস। একা হাঁটছি। সামনে আসছেন এক মধ্যবয়স্কা মহিলা। তাঁর সঙ্গে আছে একটি বছর
চারেকের মেয়ে। মেয়েটি বেশ প্রগল্ভা। পরিষ্কার উচ্চারণে জোরে জোরে কথা বলে চলেছে- ‘জানো মাসি, ঠাকুমা কোন
কাজ করে না। শুধুই ব’সে ব’সে
গেলে। মা সারাদিন খাটে। ঠাকুমা কথায় কথায় মাকে জ্ঞান দেয় আর অনেক বাজে কথা বলে।’ তারপর ওরা পাশ দিয়ে চলে গেল। প্রথম মনে হল, এইটুকু মেয়ে, বড্ড পাকা-
একেবারেই ইঁচড়ে পাকা। এ ধরনের মেয়েরা বড় হয়ে দজ্জাল হয়। মানুষের মন বিষোয়। হঠাৎ
ভাবলাম, আচ্ছা, মেয়েটি
কি সব বুঝে বলছে?
এ বয়সে কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল, বোঝার কথা নয়। কোন কাজ মায়ের করা উচিত আর কোন কাজ ঠাকুমার
করা উচিত, তাও বোঝার কথা নয়। কাকে বলে জ্ঞান
দেওয়া সে তো আরোই বোঝার কথা নয়। নিশ্চয়ই কথাগুলো ও মায়ের মুখ থেকে বহুবার শুনেছে।
এবার পরে যদি ও ভাবতে শেখে যে সব শাশুড়িরা বিনা কারণে বউয়েদের ওপর অত্যাচার করে আর
বউয়েরা অত্যাচার সহ্য করে মুখ বুজে কাজ করে এবং তাই সব শাশুড়িরাই খারাপ- তাহলে
বউমা হিসেবে ওর আচরণে তা ধরা পড়বে। তখন অন্যদের কাছে ও হবে এক দজ্জাল বউমা। ও
নিজেও জানবেনা কেন ও এমন আচরণ করে। এমনকি শাশুড়ি যদি ওর ভালর জন্য ভাল কথাও বলেন, তার অপব্যাখ্যা করতে পারে মেয়েটি। ও বুঝতে পারবেনা, ওর মধ্যে কবে তৈরি হয়েছে এক stereotype। ও
বেরিয়ে আসতে পারছেনা এর কবল থেকে। কারণ ওর মধ্যে বেরিয়ে আসবার কোন ইচ্ছে থাকতে
পারেনা। ও ‘ইন্ডক্ট্রিনেটেড’।
যে যা শুনতে শুনতে বড় হয় বা
যা দেখতে দেখতে বড় হয়, সে সবই তার পরবর্তীকালের সব
চিন্তা-ভাবনার মূলে থাকে। ছোটবেলায় শিশুরা শোনে, বাবা-মা
কে মেনে চলতে হয়, শিক্ষকদের কথা মেনে চলতে হয়, বড়দের কথা শুনতে হয়। যে সব বড়দের মধ্যে তারা বড় হয়, তাদের মত করেই তারা ভাবতে শেখে। পরে ভাবে এগুলো তাদের
নিজস্ব ভাবনা। প্রয়োজনে তারা এই ভাবনাগুলোর সমর্থনে নিজস্ব যুক্তি তৈরি করে। তারা
মেনে নিতে পারেনা অন্যদের যুক্তি (যাদের যুক্তিগুলো আবার তাদের বড়দের কাছ থেকে
পাওয়া)। আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি এই ভেবে যে মেয়েরা শাড়ি পরবে- তাতে শালীনতা
বজায় থাকে। তাই এখন যদি আমরা মেয়েদের স্কুলের পরিচালন সমিতিতে থাকি, তাহলে স্কুলের দিদিমণি দের শাড়ি পরার সমর্থনে অনেক যুক্তি
হাজির করি। এই যুক্তিগুলি আমাদের মতামত- যে মতামতগুলি আমাদের অজান্তে অনেক আগে
থেকে মনের গভীরে তৈরি হয়েছে। ধাক্কা খেলাম সেদিন আমার এক ইন্দোনেশীয় বন্ধুর কথা
শুনে। ও বললো, ‘আচ্ছা, তোমাদের
দেশের মেয়েরা এত নির্লজ্জ কেন? এমন একটা
পোশাক পরে, যাতে একেবারেই শালীনতা নেই।’ ওদের ভাবনা- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরীরের মধ্যভাগ উন্মুক্ত কেন? দেখছি, আমাদের মন
যেভাবে তৈরি, সেভাবেই তো তৈরি হয়েছে আমাদের
দৃষ্টি। আমরা অন্যদের কথা মানতে পারিনা কারণ আমাদের সীতা, দ্রৌপদী, সাবিত্রী- এঁরা সবাই শাড়ী পরতেন কিনা!
আমাদের মহাকাব্য , আমাদের সাহিত্য, আমাদের
ভাবনা চিন্তা তৈরি করে দিয়েছে। সীতা স্বামীর কাছে বার বার অগ্নিপরীক্ষা দেবেন।
আমাদের সব সীতারাই আদর্শ স্ত্রী হবার জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হবেন।
লক্ষ্মণ শূর্পণখাকে অপমান করবেন। তার প্রতিশোধ নিতে গেলে রাবণ দোষী হবেন। এই যে
ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ সবের পেছনে আমাদের
ধারণা। এই ধারণা কে এক কথায় ভুল বলা অন্যায়। সব বদ্ধমূল ধারণাই মতামত সমর্থিত। এই
মতামত বহুদিন ধরে তৈরি। তাই কি যুক্তিসম্মত?
অনেকদিন শিক্ষকতা করেছি।
শিক্ষকতা বলতে শেখানো বুঝেছি। শেখাতে গেলে পরিশ্রম করতে হয় জানি। বারে বারে দেখেছি
অনেক পরিশ্রম করার পরেও ছাত্ররা শেখেনা। একবার এক বিখ্যাত শিক্ষাবিদ বললেন, ‘বেশি শেখানো মানেই না শেখানো।’ ভাবলাম
এ আবার কি কথা? এ তো ফাঁকিবাজি! উনি বোঝালেন, তুমি যতটা শেখাচ্ছো সবটা তো তোমার ছাত্ররা শিখবে না। ওরা
শিখবে। প্রশ্ন হল তুমি কি শেখাতে পারো? ওরা শিখতে
চাইলে তুমি সাহায্য করতে পারো মাত্র। কথাটমানতে পারলাম না। ওরা ছোট্ট শিশু, ওরা শিখতে চাইবে না তাই তো স্বাভাবিক। বড়রা শেখালে তবেই তো
তারা শেখে। আমরা যা শিখেছি সবই তো বড়দের শেখানো। আমরা তো তাঁদের কাছ থেকে ভালমন্দ
বিচার করতে শিখেছি। শিখতে যে হয় তাও তো শিখেছি।
একজন অভিভাবক এক শিক্ষককে
বললেন, ‘আচ্ছা আমার ছেলের লেখাপড়ার ব্যাপারে
আপনার অভিমত কী?’ শিক্ষক বললেন, ‘আমার কিছুই বলার নেই। ওকে একেবারেই বুঝতে পারি না- ও আমার
কথা শোনেই না।’ অভিভাবক একটু ভাবলেন, বললেন, ‘স্যার, ওর কথা বুঝতে চাইলে তো ওর কথা শুনতে হবে। আপনার কথা শোনানো
তো পরের কথা।’ শিক্ষক অভিভাবকের কথা বুঝতেই পারলেন
না। তিনি তো এভাবে ভেবে দেখেন নি। কারণ তিনি ‘ইন্ডক্ট্রিনেটেড’।
আমরা সবাই সবার ভাল চাই।
আমাদের সবার ভাবনা ভাল। আমি যুক্তিবাদী। তাই সব যুক্তি দিয়ে বিচার করি। অন্যেরা
তাই আমার কাছে অযৌক্তিক কথা বলে। কেন বলে জানিনা। আবার অন্যেরা আমাকে বলে গোঁড়া।
আমার কিন্তু মনে হয়, ওরা গোঁড়া- কতকগুলো ভুল ধারণা নিয়ে
আছে। আমরা কেউ কাউকে বুঝতে পারিনা। একদল চাঁদ দেখছে, বলছে-
‘আহা! এমন চাঁদের আলো!’ আরেক
দল পায়ের কাছে ছ’পয়সা পড়ে আছে- ভাবছে, ‘আরে বোকারা- চাঁদের আলো দেখার এই কি সময়! পয়সাগুলো কুড়িয়ে
নে।’ কে ভাল কে মন্দ জানিনা। দু’দলই নিজেদের মনে করে সঠিক। কারণ বুঝতে পারিনা। একজন যখন
আমার মনের মতো আচরণ করেনা, তাকে পাগল
বলা যায়। যখন দেখি আমার দলেও আছেন অনেকে, আবার আমার
বিপক্ষেও অনেকে, তখনই সব গুলিয়ে যায়। দু’দলই তো যুক্তিবাদী। যুক্তি তো প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু
প্রমাণের ধার কেউ ধারেন বলে মনে হয় না। সব্বাই আন্তরিক ভাবে নিজের মতকেই যুক্তি
বলে মনে করেন। এই যুক্তিগুলির সপক্ষে তাঁদের যুক্তি হ’ল-
এগুলি পুরুষানুক্রমে আমরা মেনে এসেছি। দেখেছি মানলে ভাল হয়। সবাই কি আমরা ‘ইন্ডক্ট্রিনেটেড’!
একদল মানুষ আছেন যাঁরা
সংখ্যায় কম, তাঁরা কোন কিছুকে মেনে নেন যখন তাঁর
বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে তাকে সত্য বলে মনে করেন। এই সত্যটিকে তাঁরা ততদিনই
সত্য বলে বিশ্বাস করেন, যতক্ষণ না, অন্য কেউ তার অসত্যতা প্রমাণ করেন। এঁদের সবার একটা ধর্ম
আছে- সেটি হ’ল- একটি কর্তব্যকে সামনে রেখে কাজ করা। কর্তব্যটি
হ’ল অকারণে কারও কথাকে সত্য বলে মেনে না নেওয়া।
এককথায় সন্দেহ করাই হ’ল এঁদের ধর্ম। এঁদের কাছে শেষ কথা
বলে কিছুই নেই। এঁরা অনেক গৃহীত সত্যকে
অবিশ্বাস করার জন্য বা তাতে সন্দেহ প্রকাশ করার জন্য মানুষের বিরাগ-ভাজন হয়েছেন-
বহু দুঃখ সহ্য করেছেন। জীবদ্দশায় সমালোচিত হয়েছেন- অত্যাচারিত হয়েছেন- তবু বলেছেন-
‘I take nobody’s word for it.’
এই সন্দেহ নিয়ে এঁদের জীবনের
যাত্রা শুরু। আমরা যখন অনেক কিছুই জেনে
ফেলেছি আর আমাদের অনেক ব্যাপারেই মতামত তৈরি হয়েছে- তখন এঁরা গর্ববোধ করেন এই ভেবে
যে এঁদের বিশ্বাস খুব নড়বড়ে। এঁরা আতঙ্কিত যে, যে
কোন সময়ে এই বিশ্বাসে কেউ না কেউ অবিশ্বাস করতে পারেন। এঁরা সক্রেটিস এর মতো বলেন
না-‘আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না।’ এঁরা বলেন, ‘আমি জানি যে
আমি কিছু জানি, সে জানা হয়তো খুবই কম।’ আর এই জানার সত্যতা যে কোন মুহূর্তে অপ্রমাণিত হলে এঁরা
আবার নতুন করে ভাবনা শুরু করেন। এঁরা অন্যদের কাছ থেকে শেখেন কেমন করে শিখতে হয়।
সারা জীবন ধরে শিখে চলেন বলে এঁরাও শেখেন, আর
আমরাও এঁদের কাছ থেকে শিখি। এঁদের কাছ থেকে পাওয়া আমাদের সেরা শিক্ষা হল- শেখার
শেষ নেই- জানার শেষ নেই- অবিশ্বাস বা সন্দেহের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস তৈরি হয়- আবার আর
এক অবিশ্বাসীর চেষ্টায় এই বিশ্বাস ভেঙ্গে গিয়ে নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়। এঁরা এই
পৃথিবীকে বিশ্বাস করেন, এর রহস্যময়
সৌন্দর্যে বিশ্বাস করেন। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে পা দেন না। অন্তরের পথে যুক্তি ও
প্রমাণের সাহায্য নিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করা এঁদের অক্ষয় অধিকার। ছলনাময়ী সৃষ্টির
বিচিত্র ছলনাজালই এঁদের যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করে অবিশ্বাসের পথে সত্যের সন্ধানী
হতে।