৬ সহস্র পীতবর্ষ:
আজ উইসিনুন চলে গেল। নিঃশব্দে। অনেকদিন ভাবার পরেই
নিল সিদ্ধান্তটা। জানতাম,
তৈরিও ছিলাম, কোন অনুতাপ বা শিশুসুলভ টানও
ছিলনা। তবু আমায় পেয়ে বসেছে এই ‘বিষণ্ণতা’। সামনের ঝর্ণার জল, নতুন কোন গবেষণা- এমনকি ওই হলুদ
নক্ষত্রের দিগন্ত পার করা, যাকে এখন সবাই বলি বিসর্জন- কিছুই
আর ঠিক সেই ইচ্ছে জাগাতে পারছেনা পরের দিনের সব কাজ করার। এ এক অদ্ভুত রোগ।
চিকিৎসা আজও আমাদের অজানা। আমাদের গ্রহে এর অস্তিত্বও কেউ জানেনা, কিন্তু এখানে! একটা গোটা প্রজাতি উজাড় হয়ে গেল এই মহামারীতে। উইসিনুন,
উওয়ারুহ্ন, উইনিড্রোন- সব তাবড় প্রকৃতিবিদ হার
মেনেছিল এর কাছে। সবাই শেষ অবধি মেনে নিয়েছিলাম, এটা এই
গ্রহেরই আবহাওয়ার কোন বৈশিষ্ট্য- কারণ ছাড়াই মানসিক অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন আর
অদ্ভুত এক জীবন-বিমুখ অভিব্যক্তি গ্রাস করে রোগীকে। লজ্জাজনক এক বিষয়ে অপরিসীম
গুরুত্ব আরোপ করে তখন সে- আত্মচিন্তা। প্রজাতি নয়, তার কাছে
তখন বড় হয়ে ওঠে ওই সামান্য অস্তিত্ব- নিজ দেহ-মন। আমি মোউন-উহ্, একমাত্র নীরোগ প্রাণ অবশিষ্ট আছি এই প্রজাতির। সেও বোধহয় আর ঠিক থাকলো না।
আমিও ‘বিষণ্ণ’।
আর কেউ থাকলো না। উইসি- ওকে শেষ দিকে এই বলেই ডাকতে
শুরু করেছিলাম,
ও-ও আর আপত্তি করতো না- সবচেয়ে শক্ত ছিলো বলে আজ অবধি ছিলো। নইলে... ওর
কথা এত মনে পড়ছে... আমিও কি একই দিকে এগোচ্ছি?
সামনের সমতলের আদি-বাসী গোষ্ঠীর নেতা এসেছিলো আজ-
প্রতিবারের মতো এবারও নানা সমস্যা নিয়ে। সবক’টাই অতি সাধারণ- এদের মতোই। অদ্ভুত এই
প্রজাতি! জাতিগত ঐক্য কাকে বলে এরা জানেনা, নিজের
কার্যোদ্ধারের পর অন্যের কথা ভাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনা, অথচ একা কিছুতেই থাকবেনা- বাকিদের নিয়ে চলতে না পারুক, সঙ্গে চাই। শারীরিক রাসায়নিক গঠন অস্থির, তাই
ক্ষণস্থায়ী এরা প্রত্যেকে। শুধু তা-ই নয়। এই গ্রহের সব প্রাণ সেই একই নিয়ম মেনে
অল্প-সময় বাঁচে। নইলে ভাবা যায়- আমি সবার শেষে এসে একটি শ্রেণীর বিবর্তনের পাঁচটা
পর্যায় দেখে ফেললাম? আজ যে এসেছিলো, সে
হয়তো আর আসবেনা, আসবে অন্য কেউ, এসে
বলবে আগের জন ‘চলে’ গেছে। ও হ্যাঁ,
এদের ধারণা, আমরাই ওদের সৃষ্টির কারণ। ওরা ‘মারা’ যাওয়ার পর আমাদের গ্রহে চলে যায়। (আমার গভীর
সন্দেহ- গ্রহ ব্যাপারটা ঠিক বোঝে কিনা এরা) এমনকি অন্যের আচরণ পছন্দ না হলে ওরা ভয়
দেখায়- আমাদের গ্রহে না যেতে পারার ভয়। এটাও একটা মজার ঘটনা- এরা একে অন্যকে সহ্য
তো করেই না, অন্যের ক্ষণস্থায়ী অবয়বটিকে ধ্বংস করারও চেষ্টা
চালায়। উইসি আপত্তি করায় উলটো হয়েছে, এখন ওরকম করলে নিশ্চিত
ভাবেই কেউ আর আমাদের গ্রহে ‘যেতে’ পারবেনা
বলে প্রমাণ হয়েছে। যাই হোক, এই টিকে থাকার সমস্যা এই গ্রহ
নিজে থেকে সমাধান করেছে আর এক অদ্ভুত নিয়মে, আমরা নাম
দিয়েছি- প্রজনন। অদৃষ্টপূর্ব এক রীতি (এখন যদিও অভ্যেস হয়ে গেছে), তৈরি করে নতুন এক প্রাণ- টিকে থাকে প্রজাতি। যখন এসেছিলাম, তার পর থেকে এখন এতটাই উন্নত, বিশ্বাসই হয়না যে এরা
সেটুকু জানার আগেই শেষ হয়ে যায়, যা আমাদের গ্রহে এক নতুন
নির্মিত শরীর কোন বিষয় বেছে নেওয়ার আগে শেখে। যখন এসেছিলাম, তখন
চার অঙ্গে ভর করে চলাফেরা করলেও, এখন ওদের দেবতা- অর্থাৎ
আমাদের নকলে পিছনের দু’অঙ্গে ভর করে চলার চেষ্টা করছে এদের
এক অংশ।
কোথা থেকে কোথায় এসে পড়লাম... এই রীতি-বহির্ভূত
আখ্যান যে কেন লিখে চলেছি,
জানিনা। এসেছিলাম আমরা তেত্রিশ জন, এখন একা
আমি পড়ে রয়েছি। চাইলেই ফিরে যেতে পারি। চাইছিলাম না, তা-ও
নয়। কিন্তু উইসি চলে যাওয়ার পর কি যে হয়েছে- আজ সারাদিন সামনের জলাশয়ের দিকে
তাকিয়ে থেকেছি। রোগের সব লক্ষণ স্পষ্ট। আমিও কি তবে আর বেশিদিন থাকবো না? কে জানে...
৭০ সহস্র পীতবর্ষ:
বেশ কিছু সময় পর খুঁজে পেলাম এই লেখাটা। সত্যি! কত
কি হয়ে গেল এর মধ্যে- সেই কোন ধূসর অতীতে আমি এক ভিনগ্রহী ছিলাম। আজ আমি এক নীলচে
গ্রহের একমাত্র দেবতা। ঠিক একমাত্র নয়, জানতে পেরেছি গ্রহের উলটো দিকে আমাদেরই
কিছু স্বজাতি এসে থেকে গেছে। তারা এখন সেখানকার আদি-বাসীদের শাসন করে, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে কিছু জ্যামিতিক সৌধ নির্মাণও করেছে। খুব
অত্যাচার করে, খবর পাই। থাক সে কথা। আমার কথা বলি। আমি এখন
এখানকারই বাসিন্দা। নাঃ, উইসি বা উইনিড্রোনের মতো আত্মহনন
করতে হয়নি এখনো আমায়। যে উদ্ভট মানসিক অবস্থাগুলোকে আমরা রোগ বলে ভেবেছিলাম,
তা এই গ্রহেরই বৈশিষ্ট্য। সমস্ত প্রাণী, বিশেষ
করে ওই গোষ্ঠী, যারা আমাদের নকল করতো, তাদের
মধ্যে এর লক্ষণ প্রবল। এদের, এই ‘অনুভূতি’
দের আমি আলাদা সব নাম দিয়েছি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল- বিষণ্ণতা। আমি
এখন সবসময় বিষণ্ণ থাকি। আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে এখন এই প্রাণীদের মধ্যেই থাকি। নিজের
নামে এদের নাম দিয়েছি মোউন-অব্। এরা আমায় এদের সৃষ্টিকর্তা মনে করে। দোষ নেই।
গবেষণা কাকে বলে এখনো জানেনা এরা। প্রশ্ন করতে শেখেনি। বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে দিতে
আগুন ধরাতে, চাষ করতে শিখিয়েছি এদের। ঠিক করলাম কিনা জানিনা,
তবে অনুতপ্ত নই। কোন নতুন গ্রহে এসে সেখানকার স্বাভাবিক বিবর্তনের
ধারাকে অস্বীকার করে কোন বিশেষ প্রজাতির এক অংশকে এগিয়ে দেওয়া আমাদের ‘স্ব’-জাতিদের নিয়মে অন্যায়, অপরাধ।
আমি গ্রহে ফিরে গেলে আমার শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মোটেই অনুতাপ নেই।
ন্যায়-অন্যায় বোধ, ঠিক-ভুল চিন্তা বহুদিন আগেই ত্যাগ করেছি।
নইলে আজও স্ব-গৃহে খবর পাঠালাম না কেন? কেন জানাইনি যে ‘অনুভূতি’ নামের এক অদ্ভুত বোধ আমি আবিষ্কার করেছি-
এমনকি পৌঁছেছি তার গভীরতম উন্মেষস্থলে? হয়তো আমার নানা
ব্যক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার যা ফলাফল হবে, তা আমাদের
মানদণ্ডে শুভ নয়। কে জানে, হয়তো নিজ-নির্বুদ্ধিতায় এই
প্রজাতির বংশধর ধ্বংস করে ফেলবে নিজেদের। হয়তো ভুল অর্থ তৈরি করবে আমার সব
শিক্ষার। কে জানে, হয়তো আমি নিজেই রোগগ্রস্ত; প্রলাপকে জ্ঞান মনে করে ক্ষয়িষ্ণু? তবু দ্বিধা নেই
আজ বহুদিন। এই গ্রহ- এর প্রকৃতি, আবহাওয়া- সবকিছু আমায় বাধ্য
করেছে সব ভুলে এখানে থেকে যেতে। সবথেকে বেশি আকর্ষণ করেছে এই প্রজাতি। কি অসীম
সারল্য, কি অদ্ভুত প্রাণশক্তি! এরা জানে এরা কত ক্ষণস্থায়ী,
কত তুচ্ছ এই প্রাণ। তাও উদ্যম থাকে এদের, প্রতি
নিদ্রাভঙ্গে আবার খেলায় মেতে ওঠার! আসল কথা তো এখনো বলাই হয়নি। এরাও বিষণ্ণ হয়,
‘মর্মান্তিক’ বিষণ্ণ। তবু আবার জেগে ওঠে,
আবার মন দেয় নিজ-কাজে। বিষণ্ণতার কারণটা যে ভুলে যায়, তা নয়, শুধু ‘সেরে ওঠে’। সম্মিলিত স্মৃতি ছাড়া তথ্য-সঞ্চয়ের এখনো কোন পদ্ধতি জানা নেই এদের। আমি
আছি বলেই টিকে আছে লব্ধ জ্ঞান- বেশ কিছু প্রজন্ম ধরে। কিন্তু সেই অভাবকে
রোগমুক্তির কারণ মনে করা অর্থহীন। কোন এক অজানা কারণে এই প্রজাতি লড়াই করতে শিখেছে
‘বিষণ্ণতা’র বিরুদ্ধে। যা পারেনি আমার
আর কোন স্ব-জাতি। কি সেই রহস্য, জানা এখন আমার জীবনের
একমাত্র লক্ষ্য। আমি নিজে রোগগ্রস্ত। গ্রহের প্রতি আবর্তনে নিজেকে মনে করাতে হয় যে
এখনো আমার আত্মাহুতির সময় আসেনি। কতদিন পারবো জানিনা। শুধু জানি, যে অমরত্ব কে নিয়ে গর্ব ছিল আজন্ম লালিত- মনে হতো জ্ঞান-আহরণের পাথেয়,
অসীমের সখ্যতার অধিকার- সেই অমর জীবন (যা আবার আমায় এই গ্রহে দেবত্ব
দিয়েছে) এখন এক অনপনেয় বোঝা। কি সুখ জ্ঞান-লাভে? কি লাভ তার
প্রয়োগে জগতের পরিবর্তন ঘটিয়ে? এই তো বেশ আছি। না থাকলেও কি
হয়না? কেন আছি টিকে? কেন এত প্রয়োজন
জ্ঞানার্জনের? আমার প্রজাতির সন্তান হয়েছে শেষ কবে আমার মনে
নেই। সন্তান-বোধে যাদের শিখিয়েছি অনেক কিছু, তারা আমার পলক
ফেলার আগেই যখন মুছে যাচ্ছে- স্পষ্ট চোখের সামনে- আবার আসছে নতুন একদল ‘মোউন-অব্’, কি নিদারুণ বিষণ্ণতায় ঢাকা পড়েছি,
তা প্রকাশের কোন ভাষা আমার প্রজাতির জানা নেই।
৭৫ সহস্র পীতবর্ষ:
বসে আছি আমার প্রিয় জলাশয়ের সামনে। আমার নামেই নাম
রেখেছিল ওরা এই হ্রদের,
বেশ কিছু প্রজন্ম আগে- কত ‘দিন’ আগে, ঠিক মনে নেই- ‘মোউন-অপ্স্’
(জলকে তখন এরা ‘অপ্স্’ বলতো। এখন উচ্চারণ পালটে অনেকটা ‘মানস’ এর মতো শোনায়।)। স্থির করে ফেলেছি কি করবো এবার। অনেক দিন পর বুঝেছি আমার
পক্ষে সম্ভব নয় ‘মানব’-মনের (এখন এরা
নিজেদের তা-ই বলে) রহস্য সন্ধান। অনুন্নত এই গোষ্ঠী কে কখনো ছুঁতে না পারলেও আমি
পারি অন্তত একটা কাজ করতে- কে জানে, শেষের সেই মুহূর্তে হয়তো
পরিষ্কার হবে জীবনের মানে। এতদিনে উইসি-র কথার মানে বুঝতে পারছি- আমি ঠিক করেছি ওর
পথেই হাঁটবো। আমি চলে যাবো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে কত কথা যে মনে পড়ছে, তার শেষ নেই। উইসি (উইসিনুন- এরা এখন ‘বিষ্ণু’
বলে- আমি আর ঠিক করাইনি, কোনটা ঠিক বলার আমি
কে?) ঘন ঘন তার চেহারা পাল্টাতো। এরা ভাবতো, সে বুঝি অন্য কেউ। যে চেহারায় তাকে শেষ দেখা গেছিল, সেটা
এদের প্রজাতির সন্তান-ধারকদের মতো। এরা ভাবতো, সে বুঝি উইসির
‘স্ত্রী’ (সম্পূর্ণ মানবিক এক ধারণা,
আমার আজও পরিষ্কার হয়নি এর অর্থ)। তাই তার শরীরের উপরে আমি যে সমাধি
বানালাম- যা ক্রমবর্ধমান- তার এরা নাম দিল কুয়োমোলুংমা, এদের
ভাষায় দেবী। সেটা ছিল এই দীর্ঘ সমাধিস্থলের সর্বশেষ সংযোজন। যেদিকে তাকাই শুধু
কবর- যার অধিকাংশের নিচে আমার কোন এক বন্ধুর শরীর ঢাকা আছে। এরা এই সমাধিস্থলের
নাম দিয়েছে- ‘হিমালয়’ (যেখানে তুষার
থাকে)। এখন দেখতে পাই আমাদের এই কাজ এই ভূ-খণ্ডের ওপর কি প্রভাব ফেলেছে। এর একদিকে
বৃষ্টিপাত এত কমে গেছে, যে সেখানে বিরাট অংশে প্রাণ বড় কম।
অন্যদিকে, সবুজে ছেয়ে গেছে সব। আমার নিজের জন্য আগে থেকে
সমাধি বানিয়ে রেখেছি। ‘ইয়ম’ নামের একটা
ছেলে আমার পিছনে পিছনে ঘোরে, তাকে বলেছি আমার শরীর যেন রেখে
আসে এই সমাধির নিচে। জানার পর থেকেই সে ‘বিষণ্ণতা’য় আক্রান্ত। জানি, ঠিক সেরে যাবে। ওরা আমার থেকে
অনেক শক্ত। আমায় ভীষণ ভালবাসে, তাই ওই শূন্য সমাধির নাম
রেখেছে ‘সেওয়ালুংমা’ (যে পর্বতকে
অর্ঘ্য দেওয়া হয়)। কেউ কেউ ওকে ‘কাঞ্চঞ্জঘা’ও বলে। নিজের তো, তাই স্বার্থপরের মত একটু সুন্দর
দেখতে করেছি ওকে। শুধু উইসি আর উইনি র সমাধির থেকে ছোট করে বানিয়েছি।
এরা বিশ্বাস করে, শরীর শেষ হয়ে গেলেও প্রাণের
অস্তিত্ব থেকে যায়। আমার জ্ঞান- অভিজ্ঞতা- শিক্ষা অন্য কথা বললেও, ভাবতে ভাল লাগে, যদি সত্যি হত! সেওয়ালুংমার ওপর থেকে
দেখতাম এই গ্রহটাকে আরও একবার। দেখি, কি হয়- জীবনের শেষে।
ফিরে আসতে কেউ পারেনি, উইসিও না। নাকি কোন এক সত্যের সন্ধান
পেল ওরা, যা আর ফিরে আসতে দেয় না? দেখি
না, কি হয়। ফিরে আসলে, আবার লিখবো।
ততক্ষণের জন্য, ‘বিদায় পৃথিবী’।
(লেখকের মন্তব্য: কুয়োমোলুংমা আসলে মাউন্ট
এভারেস্টের নাম, তিব্বতি ভাষায়। সব anachronism আর তথ্য বিকৃতির অভিযোগ আগে থেকে মেনে নিলাম।)