Monday, September 26, 2011

ঘটি-বাঙাল-শারদ শারদ -- পারমিতা


আপনি পুজোর চারটে দিন কি খান? পনির না চিকেন? কোপ্তা না চিংড়ি মাছের মালাইকারি? মানে আপনি আমিষ খান না নিরামিষ? বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ এই উৎসবের
দিনগুলিতে খাওয়া-দাওয়াটা আপনি কেমনভাবে উপভোগ করতে চাইবেন? সেটা কি আপনার পূর্বপুরুষ ঠিক করে দিয়ে গেছেন নাকি আপনি ঠিক করবেন? বাঙালদের যুক্তি বলে, অনেকদিন পর মেয়ে তার বাপের বাড়ি আসেন। অতএব খাওয়াদাওয়াটা জমিয়ে হওয়া চাই। আর কোনোদিন না হোক অন্তত দুটো দিন অষ্টমী আর দশমীতে মটন চাই-ই। আর যদি মটনের সাথে আরও কিছু মনপসন্দ্‌ ডিশ পাওয়া যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। মানে প্রথম পাতে লাল শাক আর শেষ পাতে পিঠে পায়েসের মাঝে যতরকমভাবে সম্ভব মেনুটাকে সাজানো যায় এই আর কি! মুড়িঘণ্ট, চিতল মাছের মুইঠ্যা, তেল কই,
দই রুই, ভেটকি পাতুরী, সর্ষে ইলিশ ...... উফ্‌ বলে শেষ করা যাবেনা। বাড়িতে রান্না না করতে পারলেও no problem, আজকাল যেকোনো restaurant বা hotel-এই available এই সব রান্না। পজোর সময় তো আবার বিশেষ থালির আয়োজন। তবে এ সবের থেকেই বঞ্চিত থাকেন বা থাকতে হয় ঘটিদের। তাঁরা বলেন, পুজোর দিন নিরামিষ খাওয়াই যুক্তিযুক্ত এবং সেক্ষেত্রে lunch কিংবা dinner টা পোলাও, কোপ্তা, পনির, ‘ধোঁকাদিয়েই সারতে হয়। আচ্ছা, আপনি কি? মানে ঘটি না বাঙাল? আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, অতএব আপনার পিতা যা আপনিও তাই। আপনার পূর্বপুরুষ যদি পুজোর কটা দিন নিরামিষ খেয়ে গিয়ে থাকেন বা খান তাহলে তো হিসেব মতো আপনারও সেটাই খাওয়া উচিৎ। আগে একটা সময় ছিল যখন ঘটি-বাঙালে বিয়ের সম্বন্ধও হতো না। এখন সে বিভেদ হয়তো চুকে গেছে, কিন্তু বিভিন্ন নিয়মনীতির মধ্যে দিয়ে আজও আমরা ঐ ঘটি-বাঙালের ঠোকাঠুকিটা বন্ধ হতে দিইনি। কেউ কেউ হয়তো বা বাড়ির থেকে লুকিয়ে চুপিচুপি আমিষ খেয়ে আসেন, বাইরে থেকে আবার কেউ হয়তো অতটা সাহস করে উঠতে পারেন না। কেউ কেউ আবার ভয়ে ভয়ে মনের ইচ্ছাটা বাড়িতেই প্রকাশ করে ফেলেন। তবে তারপর যে তাঁকে কি শুনতে হয় সেটা তিনিই ভালো জানেন। আচ্ছা, এতটা বাড়াবাড়ি না হয় না-ই হল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা না হয় যেভাবে হোক ম্যানেজ করে ফেললেন। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। বোধন থেকে বিসর্জন অবধি আরো অনেক নিয়মকানুনে বাঁধা আছে পৃথগন্ন গঙ্গা-পদ্মার জীবন। বেশীরভাগই আবার পরস্পরবিরোধী। ওদেশিদের ক্ষেত্রে যেমন পরনে ঢাকাই শাড়ী-কপালে সিঁদুররে মণ্ডপ-বিহারে যান সুবেশী গৃহবধূ, তথাকথিত এদেশি’ housewife দের কিন্তু পছন্দ রকমারি সিল্ক। তেমন প্রাচীন বনেদী পরিবারের পুরুষদের সাজবিধিও সম্পূর্ণ আলাদা। উত্তরের বন্দ্যোপাধ্যায় বাবুরা চুনোট ধুতির সাথে গরদের পাঞ্জাবী পরেই অঞ্জলিটা সেরে ফেলেন, কিন্তু দক্ষিণের বাগচী বাড়িতে ফতুয়া থেকে প্যান্ট শার্ট- অস্পৃশ্য নয় কিছুই। পুজোর ব্যাপারে রকমফের-টা বাইরে থেকে চট করে বুঝবেন না বটে, কিন্তু ঘটির পূজো অনেক বেশি বৈদিক রীতি নির্ভর। তুলনায় বাঙালের দুগ্‌গা ঠাকুরঅনেকটাই ঘরের মেয়ে। ঠাকুরদালানের ভোগেও বোঝা যায় ভাগের মাকি খাচ্ছেন। ঘটি বাড়ির পুজোতে প্রতিমা-প্রমাণ মণ্ডামিঠাই আর ফলের সমাহার দেখে দুর্গার না হোক, ভক্তের জিভে জল এসেই যায়। তেমনই বাঙাল মাএর বরাদ্দ রোজকার খিচুড়ি তো বটেই, এমনকি সাদা ভাত, শাক এবং নিত্যি রকমারি মাছও। দশমীর সকালে জলের স্বাদটা অবশ্য একই, গঙ্গা বা পদ্মার নয়, চোখের জলের কথা বলছিলাম। কিন্তু সেখানেও কিছু খুচরো আচার-বিচারে দুই বাংলা আলাদা। ঘটির গুষ্টি মণ্ডপে গিয়ে ভাঙ্গা ঘটে প্রণাম সেরে, দুর্গার জলমুখ দেখে ঘরে ফেরেন। বাঙাল পরিবারে কিন্তু তখন ব্যস্ততার চূড়ান্ত। যাত্রা ঘটভরো রে, পুঁটি মাছ আনো রে......দুঃখ করার সময় কই? গুটিকতক পরিবার হয়তো এই নিয়মের বেড়াজাল ভাঙতে পেরেছেন তবে সবাই নয়। এমনটা হতেই পারে যে আপনার বাবা ঘটি অথচ মা বাঙাল, তাহলে তো আপনার শরীরে উভয়েরই রক্ত বইছে। তাহলে আপনার পাতে কে ঠাঁই পাবে? আপনার পোশাকই বা কি মেনে হবে? আপনার ইচ্ছা? নাকি আপনার পরিবারের রীতিনীতির প্রতি আপনার শ্রদ্ধা? আচ্ছা রীতিনীতি না মানলে কী শ্রদ্ধা রাখা যায়না? নাকি উল্টোটা? ওসব মেনে চলার মধ্যেই শ্রদ্ধা লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্ন চুলোয় যাক। বরং মন দিই উভয়ের common ব্যাপারগুলোতে। আজও শরৎ আলোর কমল বন”, শিশির ভেজা শিউলি আর মাঠের ধারের কাশফুল সবার মনেই একই পুলক জাগায়। দশমীর সিঁদুরখেলা বা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় উদ্দাম নাচানাচি- সমান শরিক দু-পক্ষই। কিন্তু পুত্রবধূ কিংবা ব্যাটার বউ’- কেউই পুজোর কদিন আর নাড়ু-মুড়কি বানিয়ে time waste করতে পছন্দ করেন না। দুই তরফেরই gen-Y আজ জিন্‌স-টি-শার্ট ছেড়ে পরতে চায় না ভিন্নতার সাক্ষ্যবাহী কোন জামাকাপড়। একটা মজার কথা দিয়ে শেষ করি, হাল্কা সামাজিক পার্থক্যগুলোকে একটা কাঁটাতার এঁকে দিয়ে পাকাপাকি ভাবে এপার-ওপারের বিভেদ করে গিয়েছিলো পশ্চিম। আজ অনেকদিন পর সবার অলক্ষ্যে সেই পশ্চিমই বুঝি imported সংস্কৃতি দিয়ে মুছতে চলেছে সেই বিভেদ। খুব নিকট ভবিষ্যতে হয়তো একদিন আর এই শারদ ঘটি-বাঙাল বিতর্ক থাকবে না। ভয় হয়, বাঙালি পরিচয়টা থাকবে তো?

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই