Thursday, September 29, 2011

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট -- শমীক


পোস্ট ১
একটা টাকামাইন গিটার, একটা হুডখোলা উইলিস জিপ, একটা ডালমেশিয়ান কুকুর, কিছু টিচারস ফিফটি হুইস্কির বোতল আর প্রচুর বই-গান-সিনেমা।
হিরে-জহরত, সোনা-রুপো, গয়নাগাটির ব্যবসা পেরিয়ে বছর চৌত্রিশের অর্কপ্রভ দে-র জীবন-সমীকরণটা এমনই সহজ-সরল।
সম্প্রতি তাকে একটা নতুন নেশায় পেয়েছে- সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং। ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কড-ইন, গুগল-প্লাস ইত্যাদি ইত্যাদি।

সকালে একপ্রস্থ আর সন্ধে থেকে রাত অবধি সে এখন বেশিরভাগ সময় নিজের ব্লগ বা ফেসবুকে ডুবে থাকে। দুপুর বিকেলে এক বার করে ফলাও পারিবারিক গয়নার ব্যবসার বিভিন্ন শোরুমে ঢুঁ মারতেই হয়। বাবার বয়স হয়েছে, সে একাই বংশধর দি গ্রেট দে জুয়েলার্স-এর। এ দিক ও দিক বিভিন্ন শহরে তাদের শোরুম খুলছে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তো বটেই, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি। ফলে তারও অনেক দায়িত্ব। মাঝেমাঝে ট্যুরও করতে হয় তাকেই। তার বাইরে কিছুটা সময় পুরনো, বিশ্বস্ত কর্মচারীদের হাতে ব্যবসার দায়দায়িত্ব ছেড়ে নিজের জগতে মগ্ন থাকতে ভালবাসে অবিবাহিত অর্ক। তার বাবা ভাস্করের বয়স প্রায় ৭০। মা অনুরাধা ৬৫ ছুঁইছুঁই। ছেলেকে বহু বার বহু ভাবে বলে তারা এখন বুঝেছে, বিয়ে সে করবে না। আর যদিও বা করে নিজের ইচ্ছেয়, নিজের মর্জিতে যে দিন খুশি করবে। ফলে তাকে ঘাঁটায় না বাবা-মা। আর ছেলে তাদের খারাপ না। সে নিজের মতো থাকে, বেশিরভাগ তিনতলায় নিজের ছোটবেলার সেই ১৪ বাই ২০ ফুট ঘরেই কাটায় অর্ক।
ল্যাপটপ, হোম থিয়েটারে নানা দেশের সিনেমা, আইপডে ডিলান, ডেনভার থেকে অঞ্জন, ডোরস, বিটলস, এলভিস থেকে সুমন, অনুপম বা ফসিলসের গান, অজস্র বাংলা-ইংরেজি বই, এবং গিটারে সুর তোলা-গান বাঁধা নিয়ে তার সময় কেটে যায়। রয়েছে তার কুকুর ডন। তার সুখ-দুঃখের সাথী। মাঝেমাঝে আসে তার ছোটবেলার বন্ধু রঞ্জন। আর ওদের কয়েকটা কমন বন্ধু। অর্কদের সার্দান অ্যাভিনিউয়ের তিন তলা বাড়ির ছাদে সে দিন গান হয়, আড্ডা হয়। বাবা-মাকে লুকিয়ে কিঞ্চিৎ মদ্যপান-সিগারেট। বাড়ির রান্নার লোক, ২০ বছরের পুরনো পদ্ম সেদিন খুশিই হয়। এ বাড়ির একমাত্র দাদাবাবু এমন দিনে ভালমন্দ খাবারের অর্ডার দেয়। চিকেন পকোড়া হয় ঢালাও, চাইনিজ। আরও নানারকম ভাজাভুজি। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে খাবার আনায় অর্ক, পিৎজা। না-হলে ডাল-পাঁপড় ভাজা, ভাত-চিকেনের ঝোলের বাইরে অর্ক কিছু খায় না।
অর্কদের একটা ব্যান্ড আছে। বিষ-ক্ষয়। বিশেষ পারফর্ম করে না ওরা। মাঝে মাঝে সামপ্লেস এলসে বা বিগ বেনে বাজায়। তাও তার জন্য অর্ককে প্রচুর তেল দিয়ে সাধ্যসাধনা করতে হয় রঞ্জন, বাম্পি বা সোহেলকে। রঞ্জন নিজে গানবাজনাই করে। তার রেকর্ডিং স্টুডিও আছে। বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে ওঠাবসা। প্রচুর পাব, অডিটোরিয়ামের মালিকদের সঙ্গে জানাশোনা। ওদের ব্যান্ডেরও বাজারে চাহিদা আছে। ওরা নিজেদের বাংলা ও ইংরেজি কম্পোজিশন ছাড়া আমেরিকান সং-এর কভার গায়। তবে অর্ক প্রোগ্রাম করতে, অ্যালবাম বের করতে চায় না। বলে, নিজেদের মতো করে গান করলেই হল। বন্ধুর এই যুক্তি সে মানে না, তবু রঞ্জন মাঝেমাঝেই চলে আসে অর্কর বাড়ি, রিহার্সাল দেয়। নিজেদের গান, বা এলভিস কিংবা জিম রিভস বা ব্রাদার্স ফোর, সাইমন অ্যান্ড গারফাংকলের গানের চর্চা চলে।
ইদানীং অর্ক অবশ্য এ সব এড়িয়ে যাচ্ছে। সে আজকাল মনোনিবেশ করেছে ব্লগ আর ফেসবুকে। ফিল্ম ক্রিটিক হিসেবে অর্কর বেশ নামডাক অনেক দিন ধরেই। সেই কলেজ ইউনিভার্সিটির দিন থেকেই সে এদিক ওদিক পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাত ফিল্ম নিয়ে। আজকাল নিজের ব্লগে সাম্প্রতিক হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা সিনেমার সমালোচনা করে সে। এবং নিজের ফেসবুক পেজ-এ পোস্ট করে লিঙ্ক। প্রচুর ফলোয়ার হয়েছে তার ব্লগের, ফেসবুকে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির প্রচুর বন্ধু ছাড়াও অনেক নায়ক-নায়িকা, পরিচালক প্রযোজক তার বন্ধু। কত কথা হয়, কত ধরনের আলোচনা, মতামত, ভাললাগা মন্দলাগা। সন্ধেবেলা তার একমাত্র সাথী ডনকে নিয়ে সে ঘরে বসে থাকে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে। ব্ল্যাকবেরি অফ করে দেয় ৭টায়। তারপর সে শুধু নিজের সঙ্গে সময় কাটায়। চ্যাট করে, লেখে। সিনেমা দেখে। মেপে সাড়ে তিন পেগ মদ খায়। রাতের খাবার তার ঘরে দিয়ে যায় পদ্মদি। চুপচাপ খেয়ে সে শুয়ে পড়ে ১২টা ১টা নাগাদ। ওঠে ৮টায়।
খুব দরকার পড়লে তার বাবা বা মা ওপরে আসেন। বাবা ব্যবসার খবর নেন, দেন। সোনার দাম কীভাবে বেড়েই চলেছে, কতটা সোনা কিনে রাখলে ঠিক হবে এই সময়ে, যে সব কাস্টমার মাসিক টাকায় স্বর্ণভাণ্ডার-এ নিয়োগ করেন, তাঁদের জন্য সোনা দিতে গিয়ে কত লোকসান হবে। অর্ক মন দিয়ে শোনে। সব ঠিকঠাক সাজেশন দেয়। বাবা খুশি হন। অর্ক তাঁর ছেলে ভাল। অনেক বাড়ির ছেলের মতো সে কখনও বলেনি, পারিবারিক ব্যবসা করব না। সে সব খুঁটিনাটি জানে। বোঝে। বাবাকে সাহায্য করে। পুরো দায়িত্ব সে নিতে চায়, ভাস্কর বলেন, আরও অথর্ব হই। এখনও করি যতটা পারি। ভাস্কর নিজেও খুশি এখনও এত বড় ব্যবসা নিজে দেখভাল করতে পেরে।
অর্কর মায়ের বরং ছেলের প্রতি অনেক অভিযোগ। ছেলে তাদের সঙ্গে বেশি কথা বলে না। নিজের মতো থাকে। সকাল, দুপুর যদিও বা নিজে থেকে হাসি-মজা-গল্প করে, সন্ধে থেকে নিজের জগৎ নিয়ে মেতে থাকে। ছেলের যন্ত্রণার কথাটা যে অনুরাধার অজানা নয়। একমাত্র ছেলের জীবনের সব চেয়ে বড় ধাক্কাটার কথা ভেবে তাঁরও মন ভিজে যায় অহরহ।
পোস্ট ২
সল্টলেক আউটলেট থেকে ফেরার সময় কেএফসি থেকে প্রচুর চিকেন-ফ্রাই নিয়ে ফিরল অর্ক। তার নিজের জন্য, বাবা-মা, পদ্মদি, সবসময়ের কাজের লোক ফাতিমা আর রসুল, দারোয়ান সুকুমার আর রাসবিহারী, ড্রাইভার জোনাথনের জন্য। বাবার ড্রাইভার পান্ডেজি নিরামিষ খান। তাঁর জন্য সিঙ্গাড়া। সকলের খাবার নীচে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল অর্ক। কাল একবার জিপটা মল্লিকবাজারের ইয়াসিনকে দেখাতে হবে। ক্লাচটা একটু হেভি লাগছে। ৫০ বছরের পুরনো এই জিপ। তার বাবা শখ করে কিনেছিলেন। তারপর ছেলের হাতে রয়েছে গত ১৪ বছর। বাড়িতে হন্ডাসিটি থেকে সুইফট, তিন চারখানা গাড়ি থাকলেও অর্ক জিপ ছাড়া কিছুতে পারতপক্ষে চড়ে না।
ল্যাপটপ অন করল সে। গ্লাসে ঢালল অল্প হুইস্কি। কেএফসি-র চিকেন দিয়ে জমবে ভালই। ফেসবুকে লগ করল। আজ আবার খড়কুটো সিনেমাটার রিভিউ লিখে পাঠাতে হবে দামিনীদিকে। একটা নামি পত্রিকার এন্টারটেনমেন্ট সেকশনের হেড, দামিনী বলেছে, এই লেখাটা এক্সক্লুসিভ চায় তারা। উঠতি পরিচালক বিজিতের নতুন সিনেমা। দামিনীদির অনুরোধ, তারা ছাপলে অর্ক যেন নিজের ব্লগে বা ফেসবুকে পোস্ট করে রিভিউটা। কথা রাখবে অর্ক।
ফেসবুকে গোটা কয়েক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। রোজই থাকে।
প্রথম দুটোর একটা তার মামাতো বোন টুসকি। সে সবে ক্লাস টেন। অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা, দোনামোনা করছিল অর্ক। এত ছোট ওর থেকে বোনটা। এ সব ভাবতে ভাবতে পরের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে চোখ যেতেই পৃথিবীটা কেমন দুলে উঠল অর্কর।
শ্রীজা!!!!!!
শ্রীজা সেন রায়!!!!
শ্রীজা --- বিবাহিতা। প্রথম চোটেই এই কথাটা মনে হয় অর্কর।
কিন্তু শ্রীজা সেন তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল!!!
অবাক হয় অর্ক। ঘাবড়ে যায়। কেমন ফ্যালফ্যাল করে স্ক্রিনের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে সাধারণ ভাবে ধীরস্থির হাসিখুশি, স্থিতপ্রজ্ঞ অর্ক।
অ্যাকসেপ্ট করে না অর্ক। বন্ধ করে দেয় ফেসবুক, ল্যাপটপ।
মাথাটা ঝিমঝিম করে। এক পেগ হুইস্কি না খেয়েও। ঘাম হতে শুরু করে।
ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। খোলা আকাশের নীচে। হঠাৎ খুব কান্না পায় মধ্যবয়সী সাধারণ বাঙালি উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলেটির।
হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে যায়।
অনেক দিন পরে প্রবল নেশা করল অর্ক। একটা বড় বোতল ফাঁকা করে ফেলল। রাতে কিছু খেল না। একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট তার নিস্তরঙ্গ সহজ সরল জীবনকে ওলটপালট করে দিল।
পোস্ট ৩
সকালেও কিছু খেল না অর্ক। একদিকে মাথা ভার, অন্যদিকে কাজের চাপ। মাকে বলল, অ্যাসিড হয়েছে। বলে জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
লেকের পাশ দিয়ে গড়িয়ার শোরুমে যাওয়ার সময় নিজের গতকালের কীর্তিকলাপে নিজেরই হাসি পেল অর্কর। ৭ বছর আগে চলে যাওয়া প্রেমিকার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে নিজে সেই কলেজ আমলের বোহেমিয়ান জগতে ফিরে যেতে চাইছিল সে। বোকামি, ছেলেমানুষি। ধুস। ৮-বি পেরিয়ে গেল অর্ক।
এবং না চাইতেও মনে পড়ল, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির এই দু-নম্বর গেটের সামনে তার বহু সময় কেটেছে শ্রীজার জন্য দাঁডিয়ে, একের পর এক সিগারেট শেষ করে।
পোস্ট ৪
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত শ্রীজা। বাড়ি সল্টলেকে। বাবা ডাক্তার, মাও। এক মেয়ে। বি ডি মেমোরিয়ালে পড়া বাঙালি বাড়ির আদুরে স্যাঁতসেঁতে, ন্যাকা ন্যাকা মেয়ে শ্রীজা। গান শেখে, নাচও। টানাটানা চোখ, ঘাড় অবধি ছাঁটা চুল, ফরসা। আড়চোখে চায়। অনেকটা ভেজা পলিমাটির তালের মতো। যাদবপুরে সে বেমানান। উল্টো দিকে সাউথ পয়েন্টে পড়া অর্ক ঝকঝকে স্মার্ট। গিটার বাজায়, বাবার দেওয়া অঢেল পকেটমানি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে। যাদবপুরে ইংলিশ অনার্স পড়ে। কবিতা লেখে, গান লেখে।
শ্রীজার সঙ্গে আলাপ রিমির মাধ্যমে। রিমি অর্কর ক্লাসমেট, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংই পড়ে। শ্রীজার খুব বন্ধু। একদিন মিলনদার ক্যান্টিনে অর্ক গাঁজা খেয়ে ঢুলছিল, তখন রিমি-শ্রীজার আগমন। শ্রীজার দিক থেকে অর্ক চোখ ফেরাতে পারছিল না এমন নয়, কিন্তু সে দেখছিল শ্রীজার সারল্যকে। সেখানে বসে গল্প। কী নাম, কী পড়ো দিয়ে শুরু। তারপর মাঝেমধ্যে গল্প আড্ডা। অর্ক ধীরেধীরে প্রেমে পড়ে শ্রীজার। শ্রীজাও। প্রথমে অনেক দূরত্ব, পছন্দ অপছন্দ পেরিয়ে কাছে আসে তারা। শ্রীজার জন্য অর্ক ক্লাস করা কমিয়ে ফেলে, শ্রীজাও দেরিতে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। অর্ক শ্রীজাকে ভদকা-রাম খাওয়া শেখায়, শ্রীজা অর্ককে শেখায় দায়িত্ব নিতে, জীবন সম্পর্কে সিরিয়াস হতে।
দুজনেই মাস্টার্স-এ ঢোকে। তদ্দিনে অর্কর বাড়িতে মা শ্রীজার কথা জানেন। মাঝেমাঝে শ্রীজা অর্কদের বাড়ি যায়, অর্কও শ্রীজার বাড়ি গিয়ে তার বাবা-মার সঙ্গে আলাপ করে আসে। দুই পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয় অনায়াসে, এক বাক্যে। শ্রীজা দে-পরিবারে মেয়ের জায়গা পায়, অর্ক ডাক্তার সেনের হবু জামাইয়ের আদর পায়। ভালই চলে তাদের প্রেম, জীবন, সম্পর্ক। শ্রীজাকে নিয়ে অর্ক তার জিপে ঘুরত সারাদিন। বন্ধুরা তাদের বলত, লায়লা-মজনু। একে অন্যকে না দেখে একটা দিনও থাকতে পারত না তারা।
পোস্ট ৫
গল্পটা একটু অন্য দিকে টার্ন নিল শ্রীজার ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের পরে। ভাল ছাত্রী শ্রীজা। ভাল মার্কস নিয়ে এমটেক করতেই আইবিএম, টিসিএস, সিটিএস থেকে জব অফার পেল। অর্কর আপত্তি এখানেই। সে শ্রীজাকে বলল, দে পরিবারের কোনও বৌ বাইরের কোনও কোম্পানিতে চাকরি করে না। তুই তার ওপর আইটি ইঞ্জিনিয়ার হবি। এটা অ্যাবসার্ড। তুই রিসার্চ কর। পিএইচডি কর। তারপর কলেজে পড়া। সেটা তা-ও এক রকম। মা-বাবাকে কনভিন্স করানো যাবে। কিন্তু এই সব চাকরি। জাস্ট হবে না। অথবা নিজে বিজনেস কর, বাড়ির বিজনেসে যোগ দে।
কথাগুলো আগেও অর্ক অনেক বার বলেছে। শ্রীজা তেমন গা করেনি। শুধু বলেছে, দেখা যাবে। অত দূর যাই তো। কিন্তু আসল সময়ে অর্কর সব রিকোয়েস্ট, ওজর আপত্তি পেরিয়ে শ্রীজা জয়েন করল আইবিএম-এ। তার বাবা-মায়েরও এতে সম্মতি, ইচ্ছে। তার বাবা প্রথম মেয়ের সাফল্যে নিজের হাসপাতাল আর রোগীদের মহলে কলার তুলে হাঁটতে শুরু করলেন। আর মা সাধনা আত্মীয় মহলে মেয়ের কৃতিত্বের কথা ফলাও করে জাহির করে করে শ্রীজার অহং বাড়িয়ে দিলেন অনেকটা। বড়লোকের মেয়ে হলেও শ্রীজা মানুষ হয়েছে খুব সাধারণ পরিবেশে, নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। যাদবপুরে অর্কর সঙ্গেই তার যেটুকু দস্যিপনা, বদমায়েশি। সেই শ্রীজা আইবিএমের ঝাঁ চকচকে অফিস, দুরন্ত কেরিয়ারের হাতছানি, শুরুতেই ৩৫ হাজার টাকা মাইনে এবং নিমেষে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভনে কেমন যেন হারিয়ে ফেলল নিজেকে।

আর অর্ক! শ্রীজাকে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে না দিয়ে, গুছনোর সময় না দিয়ে তাকে আরও শক্ত করে বাঁধতে গেল। ভাবল ভালবাসার জোর দেখিয়ে তাকে টেনে আনবে দে-পরিবারের সোনার সংসারের বেড়ায়।
তা হল না।
এক দিন যে শ্রীজা মাথা নীচু করে অর্কর মাকে বলেছিল, আমি ভাল বৌ হব, বছর দেড়েক আইবিএমে কাজ করে, একবার আমেরিকা ঘুরে এসে সেই শ্রীজা অর্ককে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল, তাকে বিয়ে করে বাড়ির বৌ, মিউজিয়াম পিস হয়ে থাকবে না। এটা তার জীবন, অনেক কিছু করার আছে, তার কেরিয়ার নিয়ে সে অনেক দূর যাবে।
অতএব!!!! সম্পর্কে ফাটল, ভাঙন। ব্রেক আপ।
দুজনেই দুজনের প্রতি প্রচণ্ড রক্ষণশীল, পোজেসিভ ছিল তারা। কিন্তু শ্রীজার সামনে দুনিয়ার জানলা তখন খুলতে শুরু করেছে। সে তখন উদার অর্থনীতি আর উদার মানসিকতায় তালিম নিচ্ছে গ্লোবাল সিটিজেন হওয়ার জন্য।
আর অর্কতার বাপ-ঠাকুরদার ব্যবসা, কলকাতার ১০টা শোরুমে রমরমিয়ে চলা দি গ্রেট দে জুয়েলার্স-এর ব্রাঞ্চ বর্ধমান-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-জামশেদপুরে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উদয়াস্ত খেটে যাচ্ছে।
দুজনের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে কোথায় যেন হারিয়ে যায় প্রেম।
আর যে যাবে, তাকে আটকাবে, এমন শক্তি কারও নেই।
পোস্ট ৬
শেষ দিনটার কথা এখনও মনে আছে শ্রীজার। সেই তো ভেঙেছিল সম্পর্কটা। এবং সেই দিনের পর থেকে কোনও দিন অর্কর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি সে।
দিনটা ছিল অর্কর জন্মদিন। ১৫ জানুয়ারি। রবিবার পড়েছিল ঘটনাচক্রে। অর্কর গাড়িতে করে তারা দুপুরে বেরিয়েছিল। অশান্তি তখন চরমে, কথা হয় না। এসএমএস-এও নিরন্তর ঝগড়া চলছে। তার মধ্যেও কোথাও একটা ওই রুটিনমাফিক দেখার তাগিদ ছিল, সম্পর্কটা তখনও সুতোয় ঝুলছিল বলে।
ওরা সিটি সেন্টার গেছিল। অর্কর প্রিয় কেএফসিতে বসে শ্রীজা সোজাসুজি বলেছিল, মার্চে আমি আবার ইউএসএ যাচ্ছি। আগের বারে তো ১৫ দিন ছিলাম, এ বার ২ বছরের প্রজেক্ট, ক্যালিফোর্নিয়ায়। অবাক হয়ে অর্ক বলেছিল, মানেএই ডিসেম্বরে তো আমাদের বিয়ে। তোর মা-বাবা আমার মা-বাবা তো ডেট ফাইনাল করবে।
খুব কেটে কেটে, স্বভাববিরুদ্ধ রুক্ষ মেজাজে শ্রীজা অর্ককে বলেছিল, না বিয়েটা হচ্ছে না। অন্তত আমি করছি না। দেখ, তোকে বিয়ে করতে পারব না। তুই বাড়িতে বলে দে।
অর্ক জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? শ্রীজা উত্তর দেয়, আয়াম নট রেডি। আই নিড টু ফোকাস অন মাই কেরিয়ার নাও। এখনই বিয়েতে জড়িয়ে গেলে আমার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। আর অর্ক, আই ডোন্ট লাভ ইউ এনিমোর। আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ফিলিংস লেফ্ট ফর ইউ। তুই এত পোজেসিভ, এত পুরনো ভাবনার, আমাকে চাকরি করতে দিবি না, আমাকে বাড়ির বৌ হয়ে থাকতে হবে, নট ডান। ফাইন্ড সামওয়ান এলস। আমাকে মুক্তি দে।
কথাটা শুনে অর্ক আর বসেনি। প্রেম কখন ঠিক শেষ হয়, ভালবাসা কবে কি করে ফুরিয়ে যায়, জানতে চায়নি অর্ক। শ্রীজাও উত্তর দিতে চায়নি।
সামনে আধখাওয়া চিকেনপিসগুলোর দিক থেকে ধীরে ধীরে চোখ তুলে শ্রীজার দিকে তাকিয়েছিল সে। শ্রীজা দেখেও দেখেনি, অর্কর দুচোখ ভিজে জলে। সে খুব আস্তে আস্তে বলেছিল, তুই মুক্ত। আর কোনও দিন তোকে বিরক্ত করব না, দেখিস। ভাল থাক। টাটা।
চলে গিয়েছিল অর্ক।
আর ফেরেনি। ফিরে তাকায়নি শ্রীজাও। দুঃখ হত, কষ্ট হত, এত দিনের বন্ধু, ভরসা অর্ক আর নেই। কিন্তু সে হেরে যায়নি, ভেঙে পড়েনি। নিজের কাছে নিজের প্রমাণ করার তাগিদে।
মার্চে চলে গেছিল আমেরিকা। ওখানেই আলাপ হয় কৃশানুর সঙ্গে। অর্কর একেবারে অপোজিট। ওপেন মাইন্ডেড, লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট, কৃশানু ওখানে পিএইচডি করত মলিকিউলার বায়োলজিতে। এক বছরের মাথায় কৃশানুর সঙ্গে লিভ টুগেদার শুরু করে শ্রীজা। আর দুবছরের মাথায় বিয়ে। ঘটনাচক্রে ১৫ জানুয়ারিতে। কলকাতায় বিয়ের সময় যাদবপুরের কাউকে নেমন্তন্ন করেনি শ্রীজা। জেনেশুনে। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে পড়া কৃশানু এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, কারণ সে শ্রীজার এই প্রেমের ইতাহাসের কথা জানত।
প্রায় ৫ বছর পর শ্রীজা আর কৃশানু কলকাতায় ফেরে, সঙ্গে ছোট্ট অভিকে নিয়ে। রাজারহাটে ২ হাজার স্কোয়ারফুটের পেন্টহাউস ফ্ল্যাট। টয়োটা করোলা গাড়ি। শ্রীজার অফিস সেক্টর ফাইভে, কৃশানুও ওখানেই কেমবায়োটেক জয়েন করে। অভিকে ভর্তি করায় হেরিটেজ স্কুলে। তাদের সংসার সাজানো, ছবির মতো। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি।
ফেসবুকে ফ্রেন্ড সাজেশানে হঠাৎ-ই এক দিন ভেসে ওঠে অর্কর নাম। আসলে সেই গিল্ট কনশাসের বেড়া টপকে শ্রীজা তার আর অর্কর অনেক কমন বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা ফিরে যোগাযোগ করে। আড্ডা, গল্প গান, সবই হয়। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারে, অর্ক কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি একমাত্র রঞ্জন ছাড়া। অর্ক এখন ব্যবসায়ী হিসেবে সফল, ফিল্ম ক্রিটিক হিসেবেও। তার ব্লগও খুব জনপ্রিয়। অর্ক যে লিখতে পারে, জানত শ্রীজা। কিন্তু নামী দামি ক্রিটিক! জানত না। কারণ তার সঙ্গে যখন সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে, তখনও এসব হয়নি।
অর্কর ফেসবুক প্রোফাইলে অ্যাবাউট এও তে লেখা আমি না মোটা, না রোগা। না ফরসা, না কালো, না বেঁটে না লম্বা। না ভাল না খারাপ। সব কিছুতেই আমি মাঝারি। নিজেকে এ ভাবে দেখেছি আমি। এ ভাবেই নিজেকে অ্যানালাইজ করি আমি। আই অ্যাম এ স্টুপিড কমন ম্যান, ভেরি অর্ডিনারি, ভেরি অ্যাভারেজ।
মনে পড়ে শ্রীজার। সে-ই অর্ককে এই কথাগুলো বলত। তুই না মোটা, না রোগা, না ফরসা না............।
তার মানে অর্ক তাকে ভোলেনি। কেমন আছে অর্ক। বিয়ে করেছে? কাকে? ছেলেমানুষি অনাবশ্যক কৌতূহলে পেয়ে বসে তাকে। যার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই প্রায় ৭ বছর, তার কথা হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করে।
অনেক ভেবেচিন্তে, দোটানা, দ্বিধা, লজ্জা পেরিয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা পাঠিয়ে দেয় শ্রীজা।
পোস্ট ৭
পরের দিনও শ্রীজার পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের দিকে তাকিয়ে বসে রইল অর্ক। শ্রীজা ছেড়ে যাওয়ার পর তার খবর যে একদম পায়নি ও, তা-ও নয়। তবে তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। নেভার। শ্রীজাও নয়।
আজ এত বছর পরে হঠাৎ কি মনে করে...! অর্ক আন্দাজ করতে পারে না।
কিন্তু শ্রীজার প্রতি তার প্রেম তো মরেনি। সে মরতে দেয়নি। আর কোনও মেয়েকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি সে। শ্রীজার পরে আর কোনও মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কেও লিপ্ত হয়নি। শ্রীজাই প্রথম, শ্রীজাই এখনও অবধি শেষ। এই তো তার এই ঘরে কত বার মিলনের সুখ উপভোগ করেছে অর্ক আর শ্রীজা।
ভাবনাটাকে চেপে বসতে দেয় না অর্ক। অস্থির লাগে।
খানিক উদাসীন ভাবেই শ্রীজার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করে নেয় অর্ক।
এবং তার পরেই দেখে শ্রীজা অনলাইন। রাত এখন ৯টা। টুক করে চ্যাটে অফলাইন হয়ে যায় অর্ক। দামিনীদিকে কাল লেখাটা মেল করা হয়নি। ফেসবুক থেকে লগআউট করে ব্ল্যাকবেরিটা অফ করতে গিয়ে দেখে দামিনী দির গোটা দশেক মিসড কল আর ৪টে মেসেজ।
আজই পাঠাচ্ছি, বলে একটা এমএমএস করে অফলাইনে লিখতে বসে যায় অর্ক।
পোস্ট ৮
হাই...
চ্যাট বক্সের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অর্ক। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, হাত-পা ঠাণ্ডা। বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঘাম হচ্ছে।
শ্রীজা। তাকে চ্যাটে আহ্বান করছে।
এর মধ্যে অর্ক শ্রীজার প্রোফাইল ঘেঁটেছে প্রবল আগ্রহভরে। দেখেছে তার বর কৃশানুর ছবি। ওদের ছেলে ৩ বছরের অভি-র ছবি। দেখেছে, শ্রীজা আগের থেকে মোটা হয়েছে। চুলটা অনেক বড় এখন। জিনস কমিয়ে মনে হয় সালোয়ার পরা বাড়িয়েছে। তার বর বেশ লম্বা, অন্তত অর্কর থেকে ইঞ্চি তিনেক তো বটেই। বেশ ভাল ছেলে মার্কা চেহারা। অল্প টাক, গোঁফদাড়ি নেই, চোখে রিমলেস চশমা।
দেখেছে শ্রীজাও। এবং দেখে চমকে উঠেছে। অর্ক এখনও সিঙ্গল!!! বিয়ে করেনি। তার ছবি দেখেছে। এখনও সেই ২৭-২৮ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় অর্ককে। দুষ্টু দুষ্টু কপাল ঢাকা চুল, চোখেও দুষ্টুমি মাখা। গলায় সেই মোটা সোনার চেনটা। সেই চেনা অর্ক। একই স্টাইল। নিল ডেনিম, হাসপাপিজ বা সাদা স্নিকারস এবং পছন্দের কালো, নিল বা কমলা পোলো নেক টি-শার্ট বা শাদা হাফ শার্ট। অর্ধেক ছবিই সেই চেনা জামাকাপড়ে। দেশে-বিদেশে। যে অর্ককে শ্রীজা চিনত, সে-ই অর্কই ফেসবুকে জ্বলজ্বল করছে।
সে দিক থেকে শ্রীজা বদলেছে খানিকটা। ভারিক্কি চেহারার মা, বড় পোস্টে চাকুরিরতা আধুনিকা গৃহিণী।
কৃশানু রায়ের ঘরণী তার পুরোনো প্রেমিককে এত রাতে হাই বলছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না অর্কর।
মিনিট খানেক অপেক্ষার পর অর্ক উত্তর দিল, কেমন আছিস।
উত্তর এল দেড় মিনিট পরে।
--- ভাল। ভেবেছিলাম উত্তর পাব না। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার জন্য থ্যাঙ্কস।
--- ওয়েলকাম।
দু-মিনিট সব চুপচাপ। এসি-র ঠাণ্ডায় বসেও অর্কর ঘাম হচ্ছিল।
এক দিন দেখা করবি।
অর্ক খাট থেকে পড়ে যাচ্ছিল। হাত থেকে হুইস্কির গ্লাস চলকে পাজামায় খানিকটা পড়ল। সামলে সুমলে অর্ক চোখ বড় বড় করে ভাবতে বসল। এ মেয়ের মতলবটা কী? এত বছর পরে হঠাৎ এই ঢঙের কী দরকার?
খানিক ভেবে অর্ক ঠিক করল তার হারানোর কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই। দেখি না কি হয়।
বলল কবে, কোথায়?
উত্তর এলো না।
মার্ক জুকেরবার্গের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার, ফেসবুকের চ্যাট নোটিফিকেশন জানিয়ে দিল, শ্রীজা সেন আর অনলাইন নেই। তবে অর্ক কিছু মেসেজ পাঠালে শ্রীজা তার মেসেজ বক্সে দেখতে পারবেন।
অর্ক কিছু লিখল না।
পোস্ট ৯
দিন সাতেক অর্কর ব্যস্ততার শেষ ছিল না। সে বেঙ্গালুরু গেছিল। এম জি রোডে একটি স্পেস পছন্দ হয়েছে। ডিল ফাইনাল করে ফিরল ও। ফাইনাল পেমেন্ট নেক্সট মান্থ। তার মধ্যে ওখানে ইন্টেরিয়রের কাজ কে করবে, সেটা ঠিক করতে হবে। এ বার বাবা-মাকে দিয়ে উদ্বোধন করাবে দোকানটা। সঙ্গে টলিউডের হার্টথ্রব দোয়েল মল্লিককেও নেবে। দোয়েলের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে রাজি। এ বার পুজোর আগে ও ওদের জুয়েলার্সের হোর্ডিংগুলো সব চেঞ্জ করবে। দোয়েলই নতুন মডেল হবে। কয়েকটাতে ওর সঙ্গে থাকবে উঠতি জনপ্রিয় নায়ক দব। ওদের অ্যাড-জিঙ্গলসগুলোও চেঞ্জ হচ্ছে। নবাগত অনুভব রায়কে দিয়েছে সুরের দায়িত্ব। লিখছে ও নিজেই। অনুভব গানটা গাওয়াবে খ্যাতনামা ব্যান্ড জীবাশ্মের গায়ক রূপক খানকে দিয়ে। সব মিলিয়ে অনেক টাকার এক্সট্রা ইনভেস্টমেন্ট। সে সব নিয়ে এত ঝামেলা, যে ভাল করে নিজের জন্য সময় দিতে পারছিল না অর্ক।
তবে রোজ একবার করে ফেসবুকে নজর রাখছিল, যত রাতই হোক না কেন। যদি শ্রীজার মেসেজ আসে। আসেনি।
আজ অর্ক দিল্লিতে। কাল ফিরবে কলকাতা। কনট প্লেসে একটা শপিং মলে একটা স্পেস দেখতে এসেছিল সে। সঙ্গে আরও দুটো স্পেস দেখেছে। কোনটাই তার মন মতো হয়নি। মনে হচ্ছে, লোকেশনগুলো গয়নার ব্যবসার জন্য আইডিয়াল নয়। আরেকটু দেখতে, ভাবতে হবে। বাবাও বলছে, তাড়াহুড়ো না করতে। এত ব্যবসা বাড়ালে একার পক্ষে দেখা অসুবিধে হবে। যদিও অর্ক তা মানে না। সব দোকানের হিসেবের কন্ট্রোল সে নিজের বাড়ি বসে করতে পারে, সেই ব্যবস্থা সে করিয়েছে নামি সফটওয়্যার কোম্পানিকে পয়সা দিয়ে। শ্রীজা সঙ্গে থাকলে সেই তো এ সব করতে পারত। সেটাই বলেছিল শ্রীজাকে। শ্রীজা শোনেনি।
দিল্লির ললিত হোটেল এখন বেশ নাম করা। শুক্রবার রাতের রাজধানীকে দেখছিল অর্ক। মায়াবী। খাটে শুয়ে ল্যাপটপের দিকে চোখ ফেরাল অর্ক। ফেসবুকে এখন প্রায় হাজার আড়াই বন্ধু। সকলকে চেনেও না সে। সকলের সঙ্গে তাই কথাও বলে না। অনেকে মেসেজ পাঠায়, উত্তর দেয় না। ভাগ্যিস, প্রোফাইলে তাদের পারিবারিক ব্যবসার উল্লেখ নেই। দি গ্রেট দে জুলার্সের নামে সে একটা আলাদা পেজ ক্রিয়েট করেছে, অন্তত ২০হাজার লোক সেটাকে লাইক করে এর মধ্যেই।
এই সময়েই এলো মেসেজটা। ছোট্ট দুইলাইন, ভীষণ স্ট্রেট একটা মেসেজ, যেটা শ্রীজার ট্রেডমার্ক।
পোস্ট ১০
কাল দেখা করবি। সেম প্লেস। ৩টে।
আবার কেমন যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল অর্কর শরীরে, মনে।
তার ফেরার কথা দুপুরের ফ্লাইটে। দমদম এয়ারপোর্টে অন্তত চারটে হবে পৌঁছতে। তাহলে। সেম প্লেস মানে নিশ্চয়ই যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ১ নম্বর গেটের এসবিআই এটিএম। নাকি অন্য কোথাকার কথা বলছে শ্রীজা। জিজ্ঞাসা করা উচিত কিনা বুঝতে পারল না অর্ক।
যন্ত্রের মতো উত্তর দিল, ও কে।
শ্রীজা মেসেজের উত্তর দিল, থ্যাঙ্কস। সি ইউ দেন। টেক কেয়ার।
চির কাল একই অভ্যেস শ্রীজার। অন্যের কথা শোনার ধৈর্য্য নেই। নিজের কথা বলে ক্ষান্ত।
অর্ক এ বার পড়িমরি করে বসল প্লেনের টিকিট চেঞ্জ করতে। কাল দেখল অবস্থা বেশ টাইট। অনেক দেখে কিংফিশারে সকালের একটা ফ্লাইটে টিকিট পেয়ে গেল সে।
পোস্ট ১১
এত তাড়াতাড়ি এসে গেলি। তোর না বিকেলে আসার কথা। ট্যাক্সি থেকে অর্ককে নামতে দেখে বললেন ওর মা। অর্ক বলল, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল। তাই চলে এলাম। অর্কর চোখে অনেক বছর আগে দেখা ছেলেমানুষি উত্তেজনা দেখে মায়ের চোখ এড়াল না। অনুরাধা অবশ্য হেসে বললেন, বাবা দেখিস!
বাবার সঙ্গে খানিক কথা হল দিল্লির শোরুম নিয়ে।
তারপর অর্ক চলে গেল ঘরে। স্নান করে শেভ করে ফ্রেশ হয়ে এলো। টিউশনির টাকা দিয়ে শ্রীজা ওকে লিভাইস জিনস আর একটা সাদা হাফ শার্ট দিয়েছিল মাস্টার্সের শেষে। সেগুলো পরল অর্ক। বহু বছর পরে। ওয়ার্ডরোবের নিচ থেকে টেনে বের করে।
দুপুরে বেরলো না। মায়ের সঙ্গে বসে খেয়ে উঠল প্রায় ২টোয়। অনুরাধা বললেন, সেজেগুজে চললি কোথায়। অর্ক একগাল হেসে লজ্জালজ্জা করে বলল, শ্রীজার সঙ্গে দেখা করতে।
বাক্-রুদ্ধ হয়ে গেলেন অনুরাধা।
ছেলে বলে কি? শ্রীজার যে বিয়ে হয়ে গেছে, একদিন কাঁদতে কাঁদতে অর্কই অনুরাধাকে বলেছিল। ওরা তখন ইউরোপ ট্যুরে। ভেনিসে। মনে হয়, শ্রীজার বিয়ের দিন কলকাতায় থাকবে না বলে অর্কই জোর করে ভাস্কর-অনুরাধাকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুরে বেরিয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর, প্রায় ২০ দিনের জন্য। অনুরাধা বলেছিলেন, অর্ক, মা লক্ষ্মী যা করেন, ভালর
জন্যই। তুই আর দুঃখ পাস না। তোর কষ্ট দেখে আমাদের যে আর ভাল লাগে না রে। অর্ক জবাব দেয়নি। কিন্তু শ্রীজার নাম আর কখনও করেনি।
আজ অর্কর মুখে এত বছর পরে শুনে ধাক্কা খেলেন অনুরাধা। ছেলে কিছু ভুল করছে না তো? এতদিন পরে ছেলেবেলার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা। এ সব ওই সিরিয়ালে দেখা যায়। কিন্তু অর্ক। কি হতে চলেছে, বুঝলেন না তিনি। বললেন, সাবধানে অর্ক। যা করবি ভেবেচিন্তে। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকলেন তিনি।
অর্ক মুচকি হেসে তার জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেল হুশ করে।
পোস্ট ১২
অর্ক যাদবপুর ইউনিভর্সিটির দু-নম্বর গেটের এটিএমের সামনে পৌঁছল ঠিক ২টো ৫২-র সময়। সে আগেও সব সময় শ্রীজার আগে আসত। জিপটা পার্ক করতে হয়েছে উল্টো দিকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি (আইআইসিবি)-র সামনে।
উত্তেজনায় সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল অর্কর। কিন্তু সে সিগারেট ধরাল না। গন্ধটা ভাল লাগে না শ্রীজার। লাগত না অন্তত।
৩টে ১০ নাগাদ একটা সাদা টয়োটা করোলা এসে থামল দু-নম্বরের সামনে।
নেমে এলো সে। যাকে ঠিক ৭ বছর আগে দেখেছিল অর্ক। মেরুন রঙের একটা আনারকলি সালোয়ার পরেছে শ্রীজা। সঙ্গে গোল্ডেন দুপাট্টা। মানানসই হাল্কা সোনার গয়না। কানে দুটো দামি হিরে ঝিকিয়ে উঠল।
স্ট্যাচু হয়ে গেল অর্ক। সেই যেমন হত। সামনে থেকে শ্রীজাকে আসতে দেখলে। চারপাশটা কেমন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হয়ে যেত, স্লো মোশনে চলত বিশ্ব। আর শুধু শ্রীজা এগিয়ে আসত, হরিণের মতো। অর্কর মনের মধ্যে মেটাল ব্যান্ড বাজত। কানে বেহালা বাজত। চোখে লাল-হলুদ-নীল ফুলের রাশি, মায়াবী স্বপ্নের আবেশ। অনেকটা সিনেমা সিনেমা। কাছে এসে হাতটা ছুঁত শ্রীজা, কাঁধ ধরে ঝাঁকাত। মনে হত ও পড়ে যাচ্ছে আর শ্রীজা হাসছে। ঝরে পড়ছে বরফ, ভাঙা কাচ, নূপুর। কোনও রকমে সামলে বাস্তবে ফিরে আসত ও।
কিন্তু আজ। এত বছর পরেও সেই একই ফিলিং। অবশ লাগছিল। শ্রীজাকে কি বলবে, কি দিয়ে কথা শুরু করবে। হাত ধরবে। না না। ওতো এক জনের স্ত্রী। একটা বাচ্চার মা। তাতে কি। ও তো অর্কর শ্রীজা। অনেক আগে। তবে... জড়িয়ে ধরে বলবে শ্রীজা, কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলে আমাকে।
এগোতে পা বাড়াল অর্ক।
কিন্তু এ কি। পা টা এগোচ্ছে না কেন।
কি হল অর্কর।
তিন পা পিছিয়ে এক লাফে ও সরে গেল ফুটপাথে একটা কাগজের দোকানের আড়ালে। তারপর এমন অ্যাঙ্গলে দাঁড়াল যাতে শ্রীজা ওকে দেখতে না পায়।
অটো, রিকশা, বাস, সাইকেল, গাড়ি এড়িয়ে দ্রুত পায়ে ও রাস্তাটা পেরিয়ে গেল। উল্টো দিকে ৮বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল অর্ক।
দেখল শ্রীজা ওর ড্রাইভারকে কি বলে এগিয়ে গেল ফুটপাথের দিকে। গাড়িটা এগিয়ে গেল সুলেখার দিকে।
শ্রীজা ঘড়ি দেখছে। শ্রীজা জানত, ওর অর্ক কোনও দিন দাঁড় করিয়ে রাখবে না তাকে। অর্ক সব সময় আগে আসত। সে কি বদলে গেল এত বছরে। এখনও এলো না।
অর্ক দাঁড়িয়ে রইল পান-সিগারেটের দোকানের পাশে। আড়াল করে। সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছিল শ্রীজাকে। সোজা। শ্রীজা দু-নম্বর গেটের সামনে পায়চারি করছে। বোঝাই যাচ্ছে তার হাবেভাবে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, ওরকম জায়গায় ফুটপাথে এখন আর কারও জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে সে অভ্যস্ত নয়। এখন সে অপেক্ষা করে সাজানো অ্যাপার্টমেন্টে বা অফিসের ঠাণ্ডা নরম কাচের দেওয়ালে ঘেরা কনফারেন্স রুম বা কেবিনে।
সময় পাল্টেছে। দিন বদলেছে।

পায়ে পায়ে অর্ক এগিয়ে যায় নিজের বুড়ো ঘোড়ার দিকে। জিপ নিয়ে বেরিয়ে যায়। সোজা বাড়ির দিকে।
নাহ্। দেখা করবে না শ্রীজার সঙ্গে। যে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনা যায়নি, আর যাবেও না। তাহলে এত দিন পরে কি আর হতে পারে এই সাক্ষাতে?
হয়তো ছেলেমানুষি নেশায় শ্রীজার মনে হয়েছে, তাকে ছাড়া কেমন রয়েছে অর্ক, দেখবে। দেখবে, সে বিয়ে করেছে কিনা, জানবে তার বৌ কেমন, শ্রীজার চেয়ে বেটার না ইনফিরিয়র।
আরও এগিয়ে শ্রীজা-অর্ক দুঃসাহসী হয়ে এক্সট্রাম্যারাইটাল, অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনও করতে পারে। বা আরও বেশি কিছু সমাজ বদলে দেওয়ার মতো রেভোলিউশনারি, বৈপ্লবিক। হয়তো বরকে ডিভোর্স দিয়ে সে সন্তান নিয়ে অর্কর কাছে চলে আসতে চায় দাম্পত্য জীবনে সুখ নেই বলে। হয়তো। হয়তো।কিন্তু অর্ক আর চায় না কিছু।

লাস্ট পোস্ট

বাড়িতে ঢুকে দোতলাতেই মায়ের সঙ্গে দেখা। চিন্তিত মাকে দেখে অর্ক বলল, কী হল? বিশ্বাস করলে যে আমি শ্রীজার পেছনে এখনও দৌড়চ্ছি? ধুস মা তুমি না! ইয়ার্কি করছিলাম। শোনো, সিরিয়াসলি যেটা বলছি। বিয়ে করব ভাবছি। বুঝলে। মেয়ে খুঁজছি। বাবাকে বল এ বার খদ্দেরের জন্য নয়, ছেলের বৌয়ের জন্য গয়না বানাতে শুরু করতে। সোনার যা দাম বাড়ছে। মাকে অবাক করে, আনন্দে-দ্বিধায় ভাসিয়ে হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেল অর্ক। অনেক দিন পরে মনটা ভীষণ ভাল লাগছে। হাল্কা, ফুরফুরে। ল্যাপটপটা অন করল সে। নেট কানেক্ট করল। ফেসবুকে লগ ইন। ফ্রেন্ড লিস্ট-এ গেল সে।
শ্রীজার প্রোফাইলে গিয়ে চিরতরে তাকে ব্লক করে দিল অর্ক।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই